লং ড্রাইভ


সার সার গাছ মাথা তুলে রয়েছে আকাশে। আলো পেতে হবে বলে প্রতিযোগিতা আছে, কিন্তু কেউ কাউকে ছাপিয়ে যাওয়ার উচ্ছ্বাস নেই। বেশিরভাগ সময় রাস্তার এক ধারে আটলান্টিক মহাসাগরের কালচে নীল জল। বহুদূরে আলোর বিন্দু; সম্ভবত আয়ারল্যান্ডের ক্রুজ। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে সন্ধ্যে হবো হবো। ঝিঁঝিঁ ডাকছে এক নাগাড়ে, কিম্বা অন্য কিছু। গাড়ির কাঁচ তুলতে ইচ্ছে করে না। এলোপাথারি হাওয়া ছুটে এসে নীলাঞ্জনকে কুঁকড়ে দিচ্ছে। চালকের পাশের সীটে নীলাঞ্জন চোখ বুজে হাওয়া খাচ্ছে। সে চশমা খুলে চোখ বন্ধ করে বাইরে মুখ করে আছে। পকেট থেকে ফ্লেভার্ড একটা সিগারেট বের করে সে ঠোঁটে চেপে ধরল। মৃণালিনী এতক্ষণ চুপ করে গাড়ি চালাচ্ছিল। এইবার সে আড়চোখে বিরক্ত হয়ে তাকাল। সে যে বেশিদিন স্টিয়ারিং ধরেনি, সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাও গাড়ি চলছে নিখুঁত। পাহাড়ের রাস্তার দুপাশের দৃশ্য, মেয়েমানুষের মত ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হচ্ছে। কখনো রুক্ষ আবার কখনও সবুজ! নীলাঞ্জন কোনো দিকে না তাকিয়ে, সীটটা এলিয়ে দিয়ে, চোখ বন্ধ করে কাত হয়ে শুয়ে আছে। শুয়ে শুয়ে কত কী মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ওরা ছোটবেলায় থাকত উত্তর কলকাতার একখানা পুরোনো বাড়িতে। জয়েন্ট ক্লিয়ার করে এমবিবিএস ভর্তি হতেই বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। অর্থনৈতিক অবস্থা যে খুব ভালো ছিল এমন না, তবুও স্বপ্নের পিছনে ছুটতে পিছপা হয়নি কখনো। ভয় ছিল হেরে যাওয়ার। তবু সুদিন আসবেই; সেই বিশ্বাসের জোরে দুর্গম পথটা পেরিয়ে যায়। ডাক্তারি পড়তে আসার আগেই ওর প্রেম হয় মৃণালিনীর সাথে। মৃণালিনী অবশ্য একটু স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র মেয়ে। দুর্দান্ত, চঞ্চল আর প্রাণবন্ত অথচ কত কিছুর অভাবে আন্তরিক ভাবে শান্ত, ভীতু সাধারণ অতীব ছাপোষা। ওর স্নিগ্ধ সরল গভীরতায় পৌঁছাতে বাইরের বিপরীত ভাবটা পেরোতে হয়। দীর্ঘকাল বন্ধুত্বের নানান অভিজ্ঞতার পর যখন নিজেরা নিজেদের অনুভূতিগুলো বুঝতে পারে, নীলাঞ্জন আবিষ্কার করে নতুন মৃণালিনীকে। সে এক আশ্চর্য মানুষের নাগাল। তার এই অদ্ভুত সরল স্নিগ্ধতা, নীলাঞ্জনকে বরাবর একটা অপার্থিব শান্তি দেয়।

সেপ্টেম্বর মাস। লন্ডনের আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক। তবে কলকাতার লোকজনের পক্ষে বেশ শীত। তার ওপর বেশ মেঘলা। কলকাতা নিয়ে নীলাঞ্জনের যেমন বাড়তি আদিখ্যেতা রয়ে গেছে এখনও, মৃণালিনীর তেমন কিছু নেই। গতবছর সে মহালয়ার দিন যখন মাঝরাত্তিরে ইউটিউবে মহালয়া শুনছিল, নীলাঞ্জন বেডরুম থেকে উঠে গেল ডাইনিং-এ। কফি করল, মৃণালিনীকে দিয়ে, নিজের কাপটা নিয়ে ডাইনিং-এ বসে রইল। মৃণালিনী জানে, এ সময়ে ও যতটা সম্ভব দূরে সরে যেতে চায়। নীলাঞ্জনের শিশুসুলভ আচরণগুলো ওকে খুব আনন্দ দেয়। মহিষাসুরমর্দিনীর প্রথমদিকের প্রায় সব শ্লোক আর গানই নীলাঞ্জনের মুখস্থ। তবু সে আসে না। পাশের ঘরে চলে যায় ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে। জার্নাল পড়তে পড়তে তার মন চলে যায় তার গ্রামের বাড়িতে। যেখানে আটচালায় ঠাকুর করত নদীর পাড় থেকে আসা এক বুড়ো শিল্পী। কলকাতার প্যান্ডেলর মত সেই আটচালায় না ছিল জৌলুস, না ছিল কুমোরটুলির ঠাকুরের মত পরিপাটি মুখ চোখ। তবু সেই দুগ্গাঠাকুরের কী রূপ! হাঁ করে চেয়ে দেখার মতন সেই রূপে মিশে থাকে ভোরবেলার গন্ধ। নতুন জামা যে বিশেষ হত, এমন নয় তবে এক-আধখানাতেই আনন্দ ধরানো যেত না! পঞ্চমীর বিকেলে ঢাকি আসত জমির আল ধরে। দূর থেকে ভেসে আসা সেই সুর এক নিমেষে কেড়ে নিয়ে যেত ছেলেপিলেদের মন। বইটই ফেলে রেখেই দেদার ছুট্! তারপর কলকাতা শহরের পুজোর মাদকতা গ্রাস করে ওকে। তার থেকে মুক্তি পাওয়া হয়ে ওঠেনি ওর। এসব গল্প অজস্রবার শুনে শুনে, মৃণালিনীর মুখস্থ হয়ে গেছে। সাউথব্যাঙ্কের পুজোটা ওদের রেসিডেন্ট থেকে সবচেয়ে কাছের পুজো। সেখানে বেশ লোকজন হয়, নাচগান খাওয়াদাওয়া আমোদ আহ্লাদ হয়, তবুও সেসব কিছুতেই নীলাঞ্জনের মন ছুঁতে পারে না। মৃণালিনী বুঝতে পারে সবকিছু তাই সে কিচ্ছুটি বলে না।

মৃণালিনী রিডলে হাউসে স্যোশিওলজি পড়ায় আর নীলাঞ্জন আপাতত পোর্টল্যান্ড হাসপাতালের গাইনিকোলজিস্ট। উইকেন্ডে ছুটি পেয়ে লংড্রাইভে বেরিয়ে পড়েছে দুজনে। কিন্তু নীলাঞ্জনের মুখভার করে ঘুমোনোর ভান করছে। কেবল গাড়ির ভাড়া আর পেট্রোল পুড়ছে কিন্তু টগবগে যৌবনের দুজন মানুষ লংড্রাইভের কিস্যু ফায়দা তুলছে না। এতে ভালো লাগা তো দূরস্থান, বিরক্তি বাড়ছে। শেষে একটা ক্যাফে কাম রেস্টুরেন্ট দেখে ও গাড়ি পার্ক করল। নীলাঞ্জন তখনও চুপ করে শুয়ে। স্টিয়ারিং-এ হাত রেখেই ঠিক তেমনি ভাবে বসে রইল মৃণালিনীও।  শেষে, কথা না বলে চুপ করে থাকাটা যখন প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন নীলাঞ্জন একভাবে শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করল, "কী?"
মৃণালিনী ঠায় বসে রয়েছে। নীলাঞ্জন এবার মৃণালিনীর দিকে তাকি জিজ্ঞেস করল, "কী হল? থামলি কেন?"
মৃণালিনী কিছু না বলে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে, গাড়ি থেকে নেমে গেল। ক্যাফের সাথে লাগোয়া ছোট্ট পাবও আছে একটা। গান হচ্ছে। মৃণালিনী টয়লেটে গিয়ে ভালো করে গা ভেঙে দাঁড়িয়ে রইল আয়নার সামনে। হ্যান্ডব্যাগটা বেসিনের পাশে রেখে মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল আবার। মুখ থেকে, জুলপির চুল থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে ওর কালো টি-শার্টে। কী মনে হতে, মোবাইল খুলে টিকিট চেক করল। পুজোর সময় কোথাও কোনো টিকিট নেই। কালীপুজোর পর টিকিট অ্যাভেলেভল্। মোটামুটি দুজনের পক্ষে সম্ভব এরকম নভেম্বরের দিন দেখে ডেট সিলেক্ট করে টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, নীলাঞ্জন গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। একটা টেবিলে বসে, হুডির ঘোমটা টেনে একটা এসপ্রেসো খাচ্ছে। সাথে একটা স্ট্রবেরি আর একটা চকলেট আলাদা আলাদা দুটো আইসক্রিমের বাটি নিয়ে, অন্যমনস্ক হয়ে একটার মধ্যে অন্যটা মেশাচ্ছে। আইসক্রিম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি দেখলেই মৃণালিনী তেলেবেগুনে জ্বলে যায়, কিন্তু আজ বলল না কিছু। চেয়ার টেনে বসে একটা চামচ নিয়ে আইসক্রিমের গলে যাওয়া দিকটা খেতে লাগল। নীলাঞ্জন নিজের এসপ্রেসোর কাপটা এগিয়ে দিল। মৃণালিনী একটা চুমুক দিয়ে বলল, "যাবি নাকি?"
নীলাঞ্জন চোখের দিকে তাকালো। এসব চাহনি মৃণালিনীর পাতিপাতি করে ঘাঁটা। তাই কথা বলতে হয় না বিশেষ। ও ফোনের স্ক্রীণ লকটা খুলে, এগিয়ে দিল নীলাঞ্জনের দিকে। ফ্লাইটের টিকিটের তারিখগুলো সিলেক্ট করা আছে। নীলাঞ্জন একভাবে চেয়ে রইল সেদিকে।

দমদমে ল্যান্ডিং এর পর বাইরে বেরিয়ে কার্তিক মাসের শিরশিরে ভাবটা অনুভব করল ওরা। হলদে ট্যাক্সি ডেকে, বাড়ি যাওয়ার আগে একবার বাগবাজারে ঢুঁ মেরে যাওয়া স্থির হল। বাড়িতে জানায়নি ওরা ইচ্ছে করেই। বড়সড় সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে একটা। শ্যামবাজারের কাছে ফুটপাথ থেকে কিনে নিল খানকতক ফানুস। যখন বাগবাজার ঘাটে ট্যাক্সি পৌঁছল, তখন বেশ সন্ধ্যে। গঙ্গায় জোয়ারের টান। মৃণালিনীর খোলা চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। ওরা একে অন্যের হাতের মুঠো শক্ত করে ধরল। ঘাটে লোকজন নেই। কেউ কারোর দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছে, ওদের চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। কচুরিপানার দল হুহু করে ছুটছে। প্রথম ফানুসটা জ্বেলে ছেড়ে দিতেই সেটা প্রথমে উড়ে গেল গঙ্গার দিকে। তারপর হুহু করে উপরে উঠতে উঠতে, হঠাৎ উড়ে গেল শহরের দিকে আর মিশে গেল ভিড়ে। যেভাবে সবাই যায় আর কি!

ছবি সূত্র : RAC Drive

Comments

Popular posts from this blog

টাইম ম্যানেজমেন্ট

চিন্তার বিষয়

সব আমি করেচি! আমি!