চিন্তার বিষয়
আমি কোত্থেকে এলুম- অল্প বয়সে এই চিন্তাটা ভাবিয়ে তুলেছিল খুব। অতএব এই টিকি জ্বালানো গল্পটা মা'কে প্রায়ই শোনাতে হত। সৌভাগ্যবশত 'ঠাকুর দিয়ে গেছে' বা 'মেলা থেকে এনেছি' ধরণের আলফাল গল্প আমায় শোনানো হয়নি। তবে রহস্যময় জায়গাগুলো চেপে, গল্পে অপ্রাসঙ্গিক জায়গা জুড়ে জুড়ে গল্প লম্বা হত আর ইলেকট্রিসিটি বর্জিত গেঁও রাত্তিরে মশারির ভেতরে আরও রহস্যের সৃষ্টি হত! ভরপেট দুধরুটি খেয়ে, গলায় পাউডার মেখে হাতপাখার হাওয়ায় অচিরেই সেরাত্রের মত খেলা সাঙ্গ করে ঘুমিয়ে পড়লে তবে জমির মেঠো আল ধরে বইয়ের পাতায় আঁকা সিংহ, সজারু, চিতা আর বেবুনের দল হাঁটতে বেরুত। আম গাছের ডালে আড়চোখে চাঁদ দেখতো অলস শ্লথ।
সেই বয়স থেকে আজ অবধি একমাত্র নিজের কল্পনাশক্তির ওপরই আমি দৃঢ় আস্থা রাখতে পারি। কোত্থেকে এলুম- গল্পটা ঘনঘন শোনার পর থেকেই মনে হতে থাকে, ছোটো থেকে যখন বড় হয় সবাই, তবে তখন আমার মত বিরাট সাইজের (পনেরো কেজি) চেয়েও ছোটো বাচ্চা হয়। তার চেয়েও ছোটো বাচ্চা হয়। আবার তার চেয়েও ছোট ছোট করতে করতে সেটা কত ছোটো আর চিন্তা করে কূল কিনারা পাওয়া যেত না।
বিশ্বায়নের এই যুগে হোমো সেপিয়েন্স নামক স্তন্যপায়ী ঠিক যখন থেকে আপাতত স্তন্যপান ত্যাগ করেছে (ক্ষেত্রবিশেষে অদূর ভবিষ্যতে এই মহান কার্যটি পুনরায় শুরু করবে) ঠিক সেদিন থেকেই তার চিন্তার শেষ নেই। তবে যে ফান্ডামেন্টাল চিন্তাটা দিয়ে এই অধম জীব সিরিয়াসলি স্ট্রেস নিতে শুরু করে সেটা হচ্ছে, সন্ধ্যে হলেই স্লেট-প্যাঁইসিল (পেনসিল) নিয়ে প্রগাঢ় ফ্যাসিবাদী ছ্যাবলা রুটিনটা আজও অব্যাহত থাকবে কিনা?
তারপর যখন পেনসিল ক্ষয়ে আর স্লেটের কাঠের ফ্রেম আলগা হয়ে গেল, ঘরে এন্ট্রি নিল লাইনটানা খাতা আর উটপেনসিল! উটপেনসিলের নাম কেন উট সেটা সাবপ্লটের মত একটা হালকা পার্শ্বচিন্তা জুড়ে বসেছিল। তবে এক্ষেত্রে একটানা চার মিনিট সাড়ে তিন সেকেন্ডের বেশীক্ষণ পেনসিল ধরলে হাত ঘেমে যায়। আর তারচেয়েও তাজ্জব ব্যাপার তর্জনী মধ্যমা আর বুড়ো আঙুল দিয়ে একটা উটপেনসিল ধরে লোকজন বেমালুম পরীক্ষা দিচ্ছে পাসও করছে! কথায় কথায় আরও চিন্তা আসে বুড়ো আঙুলের নাম বুড়ো কেন? সে কি জন্মেছিল সবার আগে?
দিন কয়েক কাজের খুব ধকল যাচ্ছে। কর্মহীন দেশের বেকার যুবকের কাজের ধকল- এই কথা শুনে পাঠক যারপরনাই চিন্তিত হবেন। কিন্তু যেহেতু চিন্তার কোনো শেষ নেই, তাই এতে থমকে গেলে চলবে না। তারপর আবার কলকাতায় চাঁদি ফাটানো গরম পড়েছে। অতএব চিন্তা এসে যায় গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে। সদ্য ভোট গেল। ইভিএম যন্ত্রে কারচুপি আছে কিনা, তা নিয়ে অ-বিজেপি সমর্থকরা চিন্তিত। ভোটের ফলাফলের আগে এক্সিট পোল যাই দেখাক না কেন, পিসির দল বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ পাবে কিনা, তারা সেই নিয়ে চিন্তিত। কলকাতা ইউনিভার্সিটির যারা পড়াশোনা না করে মিছিল করেছে, তারা পাস করবে কি না তাই নিয়ে চিন্তিত। সাধারণ জনগণ আবার ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়াতে হবে কিনা তাই নিয়ে চিন্তিত। আর কলকাতা তথা সমগ্র বাঙালী জাতি এই সবের পরেও, আজ কী খাবো সেই নিয়ে খুব চিন্তিত। চানাচুরের ডিবেটা আদৌ ঠিক করে এঁটেছি কিনা সেই নিয়ে মা চিন্তিত। তাছাড়াও মেট্রোয় কটা চাকা, মোদির গুহায় স্ট্রিপ-টিস্ হয় কিনা, আবার বিজেপি জিতলে জ্যামজ্যামে বিফ আদৌ থাকবে কিনা, প্রেমিকার সাথে আর কার কার লাইন থাকতে পারে- এইসব নিয়ে তেলেভাজার দোকান থেকে সিসিডি, ম্যাডক্স থেকে ম্যাকডোনাল্ড সব্বাই খুব চিন্তিত।
প্রসঙ্গত, ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে এক ভোরবেলায় পড়ার টেবিলে বসে বসে হঠাৎ হাঁস সন্দেশ খাওয়ার ইচ্ছে হয়। সেই ইচ্ছে শুধু ইচ্ছে নয়, টান। সেই টান'কে লিবিডো বললেও অত্যুক্তি হবে না। সকাল হতে না হতেই খোঁজ পড়ল হাঁস সন্দেশের। দুঃখের বিষয়, আমাদের পাড়ার দোকানের মুখপোড়া ময়রা আর হাঁস সন্দেশ ম্যানুফ্যাকচার করে না!
খালি হাতে ফেরার জ্বালা যে কী, তা যারা মেডিকেল এন্ট্রান্স রিপিট করেও ডেন্টাল পায় বা কিছুই পায় না, তারা জানে। মনে আবার চিন্তা ঢুকল, তবে কি চিটোস, পটেটো চিপস্ আর কুরকুরের প্যাকেটের আওয়াজে ময়রার দোকান থেকে চিরতরে হাঁস উড়ে গেল?
ক্রমশ সারা সপ্তাহ ধরে বিকেল হলেই বেপাড়ায়, রাস্তার এপারে ওপারে- সব খুঁজেও কোত্থাও কোনো দোকানে হাঁস সন্দেশের টিকি পাওয়া গেল না। দুঃখ যেমন ক্রমশ সয়ে যায়, এই দুঃখও মিইয়ে যেতে সময় লাগল না। তবে মিষ্টির দোকান দেখলেই ইতিউতি উঁকিঝুঁকি দিয়ে খোঁজাখুঁজির পরও হাঁস সন্দেশের দেখা পাওয়া গেল না।
এই আজ ভোরবেলা চা খেতে বেরিয়েছি। রোদ উঠছে মহাবোধি সোসাইটির চুড়ো টপকে। কলেজ স্কোয়ারের গায়ে পুঁটীরামের মিষ্টির দোকানটা তখন সবে খুলছে। ওয়ার্কশপ থেকে পালা করে মিষ্টি ঢুকছে শোকেসে। ভিজে গামছা পরা একজন মাঝবয়সী লোক একটা বড় ট্রে তে ঝকঝকে বোঁদে রাখছে। একটা ছেলে ধুনো দেখাচ্ছে। ভোরের স্নিগ্ধ গন্ধে বোঁদে, চা আর ধুনোর গন্ধে মিলেমিশে মনটা তাজা হয়ে যায় মুহুর্তেই। তবুও কোনটা কীসের গন্ধ আইডেন্টিফাই করার জন্যে চিন্তা হচ্ছে। এইসব সিরিয়াস চিন্তায় চিন্তিত হয়ে থাকলে, পৃথিবীর বহু সৌন্দর্য চোখ-ফস্কে যায়! তবুও যেন দেখতে পেলাম, একটা কোণের ট্রেতে পরপর দল বেঁধে বসছে একপাল নতুন হাঁস সন্দেশ। এ দৃশ্য প্রথম দর্শনে আলেয়া বা অবিশ্বাস্য মনে হয়!
সেই জন্মকাল থেকে অফুরন্ত চিন্তার পরে এই ভেবে চিন্তা হয় যে, এই এত লোক পছন্দসই রাজনৈতিক দলের হয়ে গলা ফাটিয়ে মরছে, তা সেই দল তাদের গলা ফাটানোর দাম দেবে? অতএব লাল নীল দল ছেড়ে মিষ্টির দোকান চিহ্নে ভোট দিয়ে নিজেদের মনকে বিপুল ভাবে জয়ী করুন। মন কথা রাখে। মিষ্টির দোকান কথা রাখে।
তখনও রাধাবল্লভি ছাঁকেনি তাই; নয়তো হংসপাখায় ছোলার ডালের ছিটে না লাগিয়ে ঘরে ফিরলে প্রাতঃভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যায়! শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে। একটু পা চালিয়ে ভাই। তবে ফিরতি পথে আবার নতুন চিন্তা জুড়ল, হাঁস সন্দেশ কি আমিষ না নিরামিষ? চিন্তার কি শেষ আছে মশাই!
Comments
Post a Comment