সোনার সন্ধানে

যখন সময় কাটানোটাই একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সময় কাটার বদলে, যেন জুড়তে থাকে ক্রমশ! বেশ খানিকটা পায়চারি হল, অথচ কারোর দেখা নেই! সারারাত জেগে। ভোর হতে বেশী দেরী নেই বোধহয়। গ্র্যান্ডে ঢোকার সৌভাগ্য আমার হবে বলে ভাবিনি, তাও আবার এই পড়ন্ত শীতের মাঝরাত কিম্বা কাকভোরে গ্র্যান্ডের ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কুয়াশা আর হিমের চোটে শরীর খারাপ হওয়ার ভয়ও হচ্ছে। এক জীবনে যে কত কী অভিজ্ঞতা হয়, ভাবতেও অবাক লাগে! ঠিক ঢিল ছোঁড়া দূরেই, বিয়াল্লিশের বাড়িটা আকাশ ফুঁড়ে উঠেছে। তার মাথায়, থেকে থেকে চিকচিক করছে আলো। অন্ধকারের ভিতরে, চূর্ণ হওয়া উচ্চতার দর্প নিয়ে, চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশানাল ভূতের মত স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর সাদা শহীদ মিনারের রঙিন আলোটা জ্বলছে স্থির হয়ে।
আসলে গল্পের শুরুটা প্রায় মাস তিনেক আগে। সুজয় আমার বহুদিনের পুরোনো বন্ধু। ওর সাথে দেখা হয়ে গেল চায়ের দোকানে। আমাদের আলাপ এই চায়ের দোকানেই। আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। ও সিটি কলেজে কমার্স পড়ত আর আমি পড়তাম বঙ্গবাসী কলেজে ফিজিক্স। তারপর ও বোম্বে গেল হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট পড়তে আর তারপর চাকরি পেল গ্র্যান্ড হোটেলে! চাকরির মাইনের সমানুপাতে ওর জেল্লা বেড়েছে আর আমার বেকারত্বে পাল্লা দিয়ে চুল হয়েছে উসকোখুসকো আর ঘরে বসা চেহারায় জমেছে আলস্যের মেদ। পড়াশোনা করতে আমার এমনিতে ভালোই লাগে। বলা ভালো, পড়াশোনা করতেই ভালো লাগে। গোটা চারেক ছাত্র পড়িয়ে নিজের খরচটা চলে যায়। তবুও ঠিক কেন জানি না, কলেজের পড়াটা পোষায়নি। একই ইয়ার বার দুয়েক থাকতে হল, তারপরই ডিগ্রির মায়া কাটিয়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়। চাকরি করার মত স্থির ধৈর্য আমার নেই। কখনোই যে চাকরির ইচ্ছে হয়নি, তা নয়। হত। মনে হত, রেলে চাকরি করি। মফস্বল ছাড়িয়ে, পুরুলিয়া কিম্বা বাঁকুড়া কিম্বা ঝাড়খণ্ড বিহারের শুকনো লালমাটির দেশে। কোনো এক অখ্যাত স্টেশনে কিছু একটা কাজ নিয়ে কেটেপড়ি। যেখানে ভোরের কুয়াশা ছাপিয়ে দিগন্তের টিলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আর সন্ধ্যেতারা উঁকি দিলেই ঘন জঙ্গলে ঝিঁঝিঁরা ডেকে ওঠে একজোট হয়ে। তখন যদি কেউ সাউথসিটি কিম্বা হাতিবাগানের গল্প বলে, ডাহা মিথ্যে বলে মনে হবে! আমার জন্ম কলকাতায় না হলেও, কলকাতা শহর যে আমার রক্তে মিশেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু টান অনুভব করতে গেলে একটু দূরত্ব দরকার পড়েই।

বেকারত্ব জিনিসটা উপলব্ধি করা যায় চাকরি চলে গেলে। চাকরির স্বাদ একেবারেই যে কখনও পায়নি, তার এসব দুঃখের বিশেষ কারণ নেই। তবুও একটা সময় আসে, যখন বন্ধুবান্ধবরা দুপুরবেলা কর্পোরেট অফিসের লাঞ্চটাইমে পার্কিং লটে টায়ার্ড হয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে আর আমার তখন ভাতঘুমে ঢলে পড়তে পড়তে, ফুরিয়ে যাওয়া আত্মসম্মানবোধের জন্যে স্মরণসভা বসাতে ইচ্ছে করে। সুজয়ের কথায়,  বিকেল চারটে কুড়ি নাগাদ আমার দাঁড়ানোর কথা ছিল গ্র্যান্ড হোটেলের গেটে। সেইমতো আমি পৌঁছে গেলাম আর ও আমায় নিয়ে বসালো ওয়েটিং রুমে। ঘন্টা পাঁচেক বসার পর ডিনার করলাম ওর সাথেই। তারপর প্রায় রাত এগারোটা থেকে ছাদে দাঁড়িয়ে। গ্র্যান্ডের ছাদে দাঁড়িয়ে কত কী মনে হচ্ছে! বিকেলে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার জো ছিল না, এখন সেখানটাই নিথর। চৌরঙ্গী ধরে একটা সাদা গাড়ি ছুটে গেল পার্কস্ট্রীটের দিকে। গাড়িটা ফ্লাইওভার ধরে মিলিয়ে গেল ক্রমশ; যেভাবে সবাই মিলিয়ে যায়।
সেন্ট্রাল কলকাতা এমন অদ্ভুত জায়গা, সে কয়েক মাসে যেকোনো আগন্তুককেই নিজের গাঢ় রসে চুবিয়ে নেয়। এই সেন্ট্রাল কলকাতার ছেলেরা মেদবহুল শরীরে কেবল ভিজে গামছা পরে দরজা খুলতে পারে, লোমের জঙ্গলে আবৃত বুক নিয়ে নির্লজ্জের মতো খালি গায়ে রাস্তায় দাঁড়াতে পারে; অথচ হোটেলে কাজ করতেই গ্রাস করে যত লজ্জা। তাই আমার শিকড় গ্রামে হলেও, কয়েক বছরের মধ্যে শহুরে বাবুয়ানি তৈরি হতে সময় লাগেনি। গ্র্যাজুয়েশান কমপ্লিট হয়নি আমার; বরং বলা ভালো, কমপ্লিট করিনি। পোষায়নি। এমএ পাস করা লোকজন যেখানে চাকরির সুযোগ পায়না, সেখানে কেবল উচ্চমাধ্যমিক পাস যোগ্যতা দিয়ে বন্ধুবান্ধবদের মত সম্মানজনক চাকরির আশা করা খুবই হাস্যকর!

সিঁড়িতে জুতোর আওয়াজ পেয়ে ফিরে তাকালাম। প্রায় চার-পাঁচ ঘন্টা বা হয়তো কয়েক যুগ একলা দাঁড়িয়ে থেকে, একটা অদ্ভুত নেশা ধরে গিয়েছিল। শ্যুট পরা তরুণের আগমন হল। আমি ইতস্তত কাটিয়ে উঠে বললাম "হ্যাঁ। আমিই আসলে ওই.."
"থাক। পরিচয়ের আর দরকার হবে না। স্যার.. আই মিন আপনার ফ্রেন্ড সব কথাই বলেছেন আমায়" তিনি বললেন।
আকাশ নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে আছে। তবুও পরিচিত ভোরের সুগন্ধটা আমি পাচ্ছি। ঠিক যেন এক গাঁয়ের বউ, বহুদূরের কোনো দিঘি থেকে স্নান সেরে সবেমাত্র হেঁটে গেছে পাশ দিয়ে। তাকে কেউ দেখেনি, অথচ বুঝতে পারছে সব্বাই।
"আপনাকে দেখে যেরকম ঘরোয়া মনে হচ্ছে, আপনি হোটেলের ওই বদ্ধ পরিবেশে থাকতে পারবেন তো?" তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন।
আমার আর বদ্ধ কি মুক্ত, এসব বিচার করার অধিকার আপাতত নেই। জীবনধারণের জন্যে যা হোক হলেই চলবে। আমি বললাম "হ্যাঁ। বিলক্ষণ! এই বিরাট হোটেলে বিরাট এলাহী ব্যবস্থা! আর এই চাকরির আকালের বাজারে একটা যদি চাকরি হয় তো.."
উনি হো হো করে হেসে উঠে বললেন "আরে, আরে অপেক্ষা করুন দাদা। ব্রেকফাস্টের সময়ই ওনারা এসে পড়বেন।"
আমি স্থির হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। ভোর হয়ে গেছে। আকাশ ফর্সা হচ্ছে আর হোটেলের ভিতরের বিরাটকায় সুপারি গাছের ডালে ডালে পাখি ডাকতে আরম্ভ করেছে।
এমন সময় কেউ কি যেন একটা বলল। পিছনে তাকাতেই দেখি, একজন বেঁটেখাটো লোক এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন "আপনাকে চা দোবো স্যার?"
আমি থতমত হয়ে কী বলব বুঝতে পারলাম না। তিনি আবার বললেন "আপনার বন্ধুই চা পাঠিয়েছেন স্যার। দিই? সারারাত তো কিছুই খাননি! ঘুমও হয়নি!"
"তবে দিন" আমি বললাম। চায়ের অভিজ্ঞতা বলতে বাড়ির চা আর পূরবী সিনেমার সামনে রাজুদার চা। কিন্তু এই চা যেন অন্য মাত্রার! তারপর কথায় কথায় স্যার সম্বোধন করছে দেখে, বাবুগিরির লোভ সামলাতে পারলাম না।
উনি চা ঢালতে ঢালতে বললেন, "আমাদের স্যার ঠিক ব্রেকফাস্টের সময়ই এসে পড়বেন।"
মনে হল একবার ওনাকেও বলি, একটা কাপে চা নিয়ে পাশের চেয়ারে বসতে। তারপর সেন্ট্রাল কলকাতার ঔপনিবেশিক আভিজাত্য আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিল। ভদ্রলোক চা ঢেলে চলে গেলেন। চিনি আর দুধের জায়গাটা এতটাই পরিষ্কার, যে সেগুলো ভোরের আলোর সাথে পাল্লা দিয়ে চকচক করছে। রাত্রের নীরবতা কেটে গেছে। এসপ্ল্যানেডে বাস ছাড়ার আওয়াজ আর শহুরে কথকতা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসছে। সবে দুটো একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে আর সাইকেলে খবরের কাগজের বান্ডিল নিয়ে ছুটতে আরম্ভ করেছে। একটু পরেই অফিস টাইম। ডালহৌসির ভীড়ে খাবারের দোকানের মাছির মতো ছুটবে ব্যস্ত শহর। আবার রাত নামবে। ঘুমিয়ে পড়বে সবাই।

ব্রেকফাস্ট লাউঞ্জে আমি আর সুজয় বসে অপেক্ষা করছি। খাবারদাবার আসবে। তার আগে কফি এল। একটা কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে, সুজয় বলতে আরম্ভ করলল, " বুঝলি ভাই, আমি যখন ইন্টার্ণশিপ করি ম্যারিয়টে। তখনই শুনেছি স্যাটাবোসের কথা। তারপর একটা সেমিনারে এলাম এখানে। ভাবলে অবাক হতে হয়, আমি হসপিটালিটির দিকটা ম্যানেজ করে যত না জানি, স্যাটাবোস রিসেপশনিস্ট হয়ে তার শতগুণ জানে। ওর প্রেসেন্সটা আলাদা লেভেল রে ভাই! কিন্তু কি জানিস; বড্ড ধাক্কা খেয়েছে জীবনে। খুব ধাক্কা!"
আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "ধাক্কা মানে?"
সুজয় বলল, "কফি জুড়োচ্ছে ভাই; খা। আমিও সেসব গল্প ঠিক ডিটেলে জানিনা রে। তবে ওই হৃদয়ঘটিত ব্যপার কিছু.. এর বেশী আইডিয়া নেই।"
শুনে অবাক হলাম না। কে আর এই জগতে আছে, যে হৃদয়ে ছ্যাঁকা খায়নি! সুজয় আবার বলল, "তবে এই যে হোটেল যা দেখছিস, তা আগে যা ছিল, এখন তার সিকি যদি থাকত রে!"
আমি এই হোটেলে কাজ করব। সুতরাং আগ্রহ স্বাভাবিক ভাবেই আরো বেড়ে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "নেই মানে! কী নেই?"
"ম্যানেজমেন্ট বদলেছে ভাই! যাগ্গে.. ওসব এখানে না বলাই ভালো। শোন। স্যাটাবোস আসছে দেশে প্রায় বেশ কয়েক বছর পর। তোর কথা ওকে মেল করেছি আমি। ও ম্যানেজারকে রেকমেন্ড করেছে নিশ্চয়ই! তোর অদ্দূর যেতে আপত্তি নেই তো?"
আমার তো কথা ছিল গ্র্যান্ডে কাজ করার! আমি অবাক হয়ে বললাম, "অদ্দূর মানে?"
সুজয় অবাক হয়ে বলল, "সেকি রে শালা! সাতকান্ড রামায়ণ পড়ে এখন বলছিস অদ্দূর মানে? অদ্দূর মানে ঘানা!"
আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। ঘানা বলতে আমি আপাতত একটা জায়গাই জানি। সেটা এই দেশ তো নয়, এই মহাদেশেও নয়! ও কি সেই ঘানার কথাই বলছে! উত্তেজনায় আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
সুজয় বলতে থাকল, "মার্কোর থেকে হারামজাদা জিমি তো হোটেলের শেয়ার কিনে নিল! তারপর মার্কো সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল অ্যাফ্রিকার গোল্ড কোস্টে নতুন হোটেল করবে বলে। তোর ব্যবস্থা ওখানেই হবে। ভাবিস না। ওরা লোক ভালো খুব!"
ও একটা ফোন রিসিভ করল। কিন্তু কোনো কথা বলল না। আমি তখন ঘানা নিয়ে ব্যস্ত। কোনো দিকে কান যাচ্ছে না। ফোনটা কেটে সুজয় বলল, "যেটা সাসপেক্ট করেছিলাম, সেটাই। চহ্ মেন গেটে যাই।"
আমি বললাম, "কেন?"
সুজয় উত্তর দিল না। শুধু বলল, "তুই বকবক না করে, যাস্ট ফলো মি"
আমি সুজয়ের পিছুপিছু চলতে লাগলাম।

গ্র্যান্ডের মেন গেটে এমনিতেই ভীড়ভাট্টা। তারপরও একটা জায়গায় যেন ঈষৎ জটলা। সুজয়ের সাথে আমিও ঐ জটলার মধ্যে ঢুকে গেলাম। খুব সাধারণ শ্যুট পরা অতি সাধারণ একজন সুপুরুষ। সে যে ঠিক কচি যুবক তা নয়; বয়স হয়েছে। অথচ শরীরী ভাষার আভিজাত্যের মখমলে মোড়া অতি উজ্জ্বল এই মানুষটিকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম! সুজয় তাঁকে বলল, "স্যাটাদা, এই ছোকরার কথাই বলেছিলাম। একটু দেখবেন। এক নম্বরের বাউন্ডুলে আর পাগল।" 
আমার নমস্কারে প্রতিনমস্কার জানালেন উনি।তারপর হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলেন "কী হে বৎস গুড়বেড়িয়া! কী সংবাদ?"
পিছনে তাকিয়ে দেখি, ছাদে আমাকে যিনি চা দিয়েছিলেন, তিনি চোখ ছলছল করে এগিয়ে আসছেন। কাছে আসতেই স্যাটাবোস জড়িয়ে ধরলেন ছাদের ওই লোকটাকে। একে একে সব পুরোনো লোকজন, যারা ছিল, এগিয়ে এল। বৎস গুড়বেড়িয়া, স্যাটাবোসকে ভিতরে যাওয়ার জন্যে বহু অনুনয় বিনয় করল, কিন্তু স্যাটাবোস গ্র্যান্ডের চৌকাঠ মাড়ালেন না। তিনি বললেন, "কী লাভ বৎস গুড়বেড়িয়া! মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? বাঁধন ছিন্ন করেই ফেলেছি যখন, আবার খামোখা জট পাকিয়ে কী লাভ?"
তারপর ভিড়টা হালকা হল ক্রমশ। সুজয় বলল, "স্যাটাদা, আপনি এই মাসতিনেক আছেন তবে! আর আমাদের মার্কোপোলো কেমন আছেন?"
স্যাটাবোস কম কথা বলেন বোধহয়। হাসলেন শুধু। তারপর মার্কোর কথা শুনে বললেন "মার্কো নিজের মত আছে! ওর সিরোসিস ধরা পড়েছে!"
কথাটা শুনে সুজয়ের মুখের ভাব দেখে মনে হল ওর সত্যিই খারাপ লেগেছে। সুজয় হঠাৎ ঘড়ি দেখে বলল, "স্যাটাদা, আমার অনডিউটি। আপনি তবে এর সাথে কথা বলুন। আমি চলি।"
এবার সুজয় চলে যেতেই স্যাটাবোস বললেন, "তাহলে? এভারগ্রিন তোমার বাটিটি কোথায়?"
আমি অবাক হয়ে গেলাম। উনি হেসে উঠে বললেন, "ওহো.. শ্রী শ্রী চিরন্তন কুমার দত্ত, বলুন আপনার আবাস কোথায়?"
আমি হাসলাম। "আমার বাড়ি বলতে হুগলি জেলায় আর এখানে আবাস আরপুলি লেনের মেসবাড়ির তিনতলার ঘর।"
উনি হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, "এই তুমি সকালে কিছু খেয়েছো?"
আমি বললাম "কফি।"
উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, "আরে ছাদকফি খেয়েছো তুমি?"
আমি বললাম, "ছাদে তো ওই গুড়বেড়িয়াবাবু চা দিয়েছিলেন। কফি তো সুজয় খাওয়ালো। ব্রেকফাস্টের লাউঞ্জে।"
শুনে উনি একটু থমকে গেলেন। তারপর বললেন, "পাসপোর্ট আছে তো? শঙ্কর আসবে এখনই। তোমাদের আলাপটা করে দিই। সেও যাবে গোল্ড কোস্টে মার্কোর হোটেলে! ওখানে মার্কোর দুটো হোটেল। দুটোই বড় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে। আমি তার একটির ম্যানেজার। তোমার যাওয়ার কাজ অনেকটাই করে রেখেছি। মাস দুয়েকের মধ্যেই সব হয়ে যাবে। আপাতত ব্রেকফাস্টের চিন্তা করা যাক নাকি হে?"
আমি ওনার পিছুপিছু চলতে লাগলাম। ডেকার্স লেনে  লুচি তরকারি অর্ডার করা হল। স্যাটাবোস বললেন, ব্রহ্মসাহেবের সুযোগ্য শিষ্য আমাদের গোমেজ সাহেব হলে ব্ল্যাককফি খাওয়াতেন। তা এখন সে উপায় নেই যখন, কড়া দুধচা-ই চলুক!"
আমি জিজ্ঞেস করলাম "ব্রহ্মসাহেব কে?"
শঙ্করবাবু হেসে উঠলেন। স্যাটাদা বললেন, "সেসব দিন গেছে চিরন্তনবাবু! এখন ব্রহ্মসাহেব আর তার শিষ্য গোমেজসাহেব; মানে ওই ছাদকফি, কেউই আর ভোরবেলা ব্ল্যাককফি খান না! যাগ্গে, শোনো। আমার আপনজন বলতে সৎমা। আমি ঠিক করেছি এইটাই আমার শেষ দেশে ফেরা। তাই আমার যাকিছু সব ওঁকেই লিখে লিগাল কাজকম্ম সব সেরে যাবো।"
স্যাটাবোসকে দেখে আমার স্বল্পভাষী বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু উনি বেশ রসিক।

অতঃপর মাসখানেক নিরন্তর খাটাখাটনির পরে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। ফ্লাইটের টিকিট কাটা হল। স্যাটাবোসের আসল নাম যে সত্যসুন্দর বোস, সেটা টিকিটে দেখে জানলাম। যাত্রী হিসেবে আমরা তিনজন। সত্যসুন্দরবাবু অর্থাৎ আমাদের স্যাটাবোস,  শঙ্কর আর আমি। শঙ্করবাবুর বয়সও আমার চেয়ে অনেক বেশী। ওরা দুজনের কেউই সংসার করেননি। দুজনেই কী মার্জিত ভদ্র আর খুবই রসিক।
ধর্মতলা থেকে একটা উবের ধরা হল। গাড়ির কাঁচ তোলা। এসি চলছে। আমি কখনোই প্লেনে চড়িনি; তার একটা উত্তেজনা আমায় ঘামিয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া নতুন দেশে যাত্রা! তাও আবার ঘানা! সত্যসুন্দরদা বসেছেন মাঝে। তাঁর দুপাশে আমরা দুজন। ফ্লাইট রাত সাড়ে বারোটায়। এখন আমার ঘড়িতে সবে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। কলকাতার রাস্তায় আলো জ্বলছে। কলকাতার ভোর, সকাল, গরমের দুপুর আর কতদিন দেখা হবে না। মনে পড়ে, কলেজের পরীক্ষা শেষ হলেই নন্দনে ব্যাকটুব্যাক তিনটে সিনেমা আর গরমের বিকেলে ময়দানে প্রেমিকার পাশে ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকার সেসব দিন। রেডরোড ধরে পাশাপাশি চুপচাপ হেঁটে যাওয়ার সেইসব স্বপ্নিল সন্ধ্যে। দক্ষিণাপনে আমাদের প্রথম দেখার সেই সিঁড়িটা, গড়িয়াহাটের মোড়ে গোলাপের ঝুড়ি নিয়ে বসা লোকটার কথা। কত কী মনে পড়ে। মনে পড়ে মায়ের কথা। বাবার কথা। মাসের শেষে, ভাড়ার জন্যে মেসমালিকের তাগাদা দেওয়ার কথা। মনে পড়ে কত রঙিন ইচ্ছে আর স্বপ্নের কথা। সুজয়ের কথা। চোখ বেয়ে নেমে আসে জল। স্মরণীয় এই শহর, স্মরণীয় গ্রামের পুকুর পাড়ের বাঁকা খেজুর গাছ থেকে কুয়াশাভেজা বড়রাস্তার মোড়।
স্যাটাদা গুনগুন করে উঠলেন, "মনে রেখো, মনে রেখো.. আমি যে গান গেয়েছিলেম.."
শঙ্করবাবু বললেন, "ভাই চিরন্তন, এই ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট সহ্য হয়ে যাবে। এসব আমাদেরও হত। খুব হত। সয়ে যায়।"
স্যাটাদা গান থামিয়ে বললেন, "জানো এসব কষ্ট, মায়া, পিছুটান এসব কেন! অল দ্যা ওয়ার্ল্ড অফ দ্যা লাভ!"
মানুষ সব মনে রেখেও, ভুলে যাওয়ার মত নিশ্চল ভান করে হাসিমুখে মেতে ওঠে আগামীতে। তাতেই প্রতিটি দিনই হয়ে ওঠে প্রতিটি দিনের মত সুন্দর!


Comments

Popular posts from this blog

টাইম ম্যানেজমেন্ট

চিন্তার বিষয়

সব আমি করেচি! আমি!