শিশু ও বিজ্ঞান

ভালো-ছেলে হতে হবে, এমন একটা চাপের সম্মুখীন হয়েছে প্রায় সবাই। কিন্তু এই ভালো-ছেলে ব্যাপারটা  ঠিক কিরকম? কোনো শিশুর জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মূলত মা-বাবা বা বাড়ির বা তার সমাজের আশেপাশে যারা থাকেন, তাদের চোখে সেই শিশুটি ভালো না খারাপ সেটা যাচাই করার একটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চেষ্টা থেকেই যায়। যেসব ছেলেমেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করা শক্ত, বা যারা কৌতূহল না মেটা অবধি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই চলে, তাদের নিরীক্ষণের পর সমাজর তথাকথিত জ্যাঠামশাইরা তকমা দেন, ছেলেটা বা মেয়েটা এঁচড়ে পাকা! কিন্তু কোনো শিশুর যদি কৌতূহল কম থাকে, তার প্রশ্নের মান যদি সহজ থাকে বা প্রশ্নের পরিমাণ কম থাকে বা একেবারেই না থাকে, তবে সেই শিশুটি অত্যন্ত সুবোধ এবং তার ভবিষ্যত উজ্জ্বল বলে ধরে নেওয়া হয়!

শৈশবে প্রথম যেকোনো কিছু দর্শনই অবাক করে মোহিত করে দেয়। সেই অবাক হওয়াই জলসিঞ্চন করে কৌতূহলী মননে এবং সেই কৌতূহল থেকেই আসে বিজ্ঞান চেতনা। কেবল বই পড়ে পরীক্ষা পাস নয়; প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের ব্যবহার করাই বিজ্ঞান শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য। জীবনের মোড় ঘুরতে ঘুরতে আমরা পৌঁছে যাই অন্য কোনখানে কিন্তু তার শুভারম্ভ হয়ে যায় শৈশবেই। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, শিক্ষা হল অন্তরের পূর্ণতার প্রকাশ। বিজ্ঞান শিক্ষা এখন সবচেয়ে চালু পাঠক্রম। কিন্তু এই বিজ্ঞান শিক্ষায় আমাদের অন্তর আদৌ পূর্ণতা কি পাচ্ছে? পেলেও কতটা? আর না পেলেও তার কারণই বা কী? এর থেকে মুক্তির উপায়ই বা কী? শিশু ও বিজ্ঞান। কিশোর বাংলা পত্রিকার শারদীয়া ১৩৫৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর এই রচনা। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ এই রচনাই সেইসব প্রশ্নের সরল উত্তর।


শিশু ও বিজ্ঞান
কিশোর বাংলা (শারদীয়া) ১৩৫৭
আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু

জ্ঞান উন্মেষের পর শিশু যখন তার চারপাশের জগতের দিকে তাকিয়ে দেখে তখন তার মন বিস্ময়ে ভরে ওঠে। চারপাশে যা কিছু সে দেখে, সবই তার কাছে রহস্যময় বলে মনে হয়, তার কৌতূহলী মনে কত প্রশ্নই না জাগে। এ জন্যে শিশুদের শিক্ষার ভার যাদের হাতে আছে, তাদের উচিত সাধারণত হাতের কাছে যেসব জিনিস পাওয়া যায়, যা ছোট ছেলেমেয়েদের মনকে আকর্ষণ করে- যেকোনো ফুল, লতাপাতা, পাখি এমনি সব টুকরা-জিনিসের ওপর নজর দিতে শেখানো। কাজ অবশ্য শক্ত। শিক্ষকদের নিজেদের মনকে ছোটদের কৌতূহলী মনে রসিয়ে নিতে হবে। তার জন্য চাই শিক্ষকদের একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা অর্জন করা, যাতে তাঁরা ছাত্রদের সঙ্গে সহজেই মিশতে পারেন।
এইজন্যে আমি বলি, আমাদের দেশে বিজ্ঞানের যা শেখানো হচ্ছে- এই যেমন ছোট ছেলেমেয়েদের শ্রেণীতে ভারী ভারী বই পড়ানো, তাতে তাদের কতটুকু লাভ হয়? বই-এর ভেতরের কথাগুলো মনে করতেই তাদের সময় চলে যায় এবং বোধহয় সেই মানেগুলো শেখা ছাড়া তারা বেশী কিছু গ্রহণ করতে পারে না।

প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় রাখতে গেলে শিশুর মনে সবার আগে জাগিয়ে তুলতে হবে কৌতূহল। তাদের নতুন নতুন জিনিস সংগ্রহ করার ভার দিতে হবে। হয়তো একটু আধটু রেষারেষির মধ্যেই সেসব জিনিসের চলবে সংগ্রহ, আর এমনি করেই প্রকৃতির সঙ্গে যোগটা আরও ঘনিয়ে উঠবে। পল্লীগ্রামের ইস্কুলে আরও একটু সুবিধে হতে পারে। এইসব ছোটছোট কাজ সারা হওয়ার পর পেঁয়াজ ছোলা মটর- যে যেমন ভালোবাসে তাকে তার বাগান তৈরী করবার ভার দেওয়া।
আমি দেখি বিজ্ঞান সম্পর্কে অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েদের এমন সব বড়বড় কথা বলা হয়, যা শুনলে আমাদেরই প্রাণে আতঙ্ক আসে। সেদিন একটা ছোটদের একটা পাঠ্য বিজ্ঞান বইতে দেখছিলুম- থার্মোমিটার কেমন করে তৈরী করা হয়, সে সম্পর্কে লেখক বোঝাতে গিয়ে লেখক ছোটদের কাছে এমন সব কথা বলেছেন যা হচ্ছে মাধ্যমিক পরীক্ষার বিষয়বস্তু। কিন্তু সাধারণ তথ্যগুলোর সঙ্গে যাতে সোজাসুজি ছাত্রদের পরিচয় হয়, তারই চেষ্টা করা উচিত।

আসল কথা, বিজ্ঞান কেন আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়? বাস্তব সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা খাঁটি হবে বলে। তা বলে এ কথা আমি বলছি না যে আমাদের জীবন থেকে কল্পনাকে একেবারে ছেঁটে ফেলতে হবে। কল্পনা থাকা ভালো। তবে বস্তু এবং সংসার সম্পর্কে যদি উদ্ভট অলৌকিক ধারণা থাকে, তবে পদে পদে আমাদের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। বেঁচে থাকতে হলে প্রত্যেকের দাবিদাওয়া সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকা উচিত। বিজ্ঞান আমাদের এইটুকু শিখতে সাহায্য করে, প্রকৃতির মধ্যে যে সত্য লুকিয়ে আছে, বিজ্ঞান সে সত্যকে উদ্ঘাটিত করে দেয়। আমাদের মনের বাইরে কোনো কিছু ঘটে গেলেই সেটা কোন দেবদানবের কীর্তি হবে, এমন কথার কোন কারণ নেই। একটু বিশ্লষণ করে দেখলে নিশ্চয়ই তার মূল কারণটা বেরিয়ে পড়বে। অসুখ করলেই যদি আমরা মনে করি যে, এ নিতান্ত দৈবের ঘটনা, দেবতার সন্তুষ্টি সাধন ছাড়া আমাদের আর কিছুই করবার নেই এতে, তাহলে আমাদের টিকে থাকা শক্ত হবে।

গাছপালা, জন্তুজানোয়ার সবের মধ্যেই শিক্ষণীয় জিনিস রয়েছে। প্রত্যেকেই আমাদের সত্যরূপে পৌঁছে দিতে চায়। আমাদের মধ্যে যদি শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়, অজানাকে জানবার আকাঙ্ক্ষা হয়, তবে আর কিছুই সহজ হয়ে আসবে। তখন শিক্ষা দেবার পদ্ধতি নিয়ে আর গোলে পড়তে হবে না।
সমস্যা হল এই যে, আমাদের ইস্কুলে পন্ডিতদের এ বিষয়ে কোনো দৃষ্টি নেই। কোন রকমে কাজ চালিয়ে তারা কর্তব্য সমাপন করেন। বেশী বয়সের ছেলেমেয়েরা কেন শিক্ষার প্রতি বিতৃষ্ণা পোষণ করে? তারা নোট মুখস্থ করে, প্রশ্নপত্র চুরি করে কোন রকমে দায়িত্ব মিটিয়ে দিতে চায়। কেন তাদের এই মনোভাব? এর জন্যে দায়ী কে?
দায়ী আমরা শিক্ষকরা, আমরা তাদের সামনে বস্তুর পাহাড় তুলে ধরেছি আর চেয়েছি সেই পাহাড়ই তারা উদ্গীরণ করুক। বস্তুর মর্মে যে সত্য নিহিত আছে, সেই সত্যের দ্বারে তো আমরা ছাত্রদের পৌঁছে দিতে পারি নি। তাই তাদের মনও আমরা পাই নি। ফলে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে শ্রমিক ও কারখানার কর্তাদের মত। পদে পদে তাই ছাত্ররা আজ বিদ্রোহ করে।
ছেলেমেয়েদের আমি বলি নিজে মনটাকে তোমরা তৈরী কর। কারুর বলা কারুর শেখানো কথায় তোমরা নির্ভর করো না, নিজেই জান।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের ছেলেমেয়েরা তা করে না। শিক্ষার বন্দোবস্তই আমাদের সেরকম নয়। আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা হাসির খোরাক জোগায় মাত্র।

অন্য অন্য দেশের শিক্ষাধারাও আমাদের দেখতে হবে। ও সব দেশে ছোটদের মনে শিক্ষার বিষয়কে গেঁথে বসিয়ে দেবার জন্যে, একটা চিরকালের ছাপ দেবার জন্যে নানা মত বন্দোবস্ত রয়েছে। যেমন ছায়াচিত্র, ভ্রমণ ইত্যাদি। আমাদের দেশে যাঁরা শিক্ষা বিষয়ে উৎসাহী, তাঁদের উচিত অন্য দেশের কিছু ধারাকে চালু করবার চেষ্টা করা। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা এখনও অল্প সচেতন। আমরা এখনও ব্যস্ত ছাত্রদের পরীক্ষা ও পাসের হার নিয়ে, প্রশ্নপত্রের আলোচনা নিয়ে। সমস্ত জিনিসটা যেন অলীক ব্যাপার চলছে। কিন্তু সরকারি ও শিক্ষাবিভাগের কর্তাদের এ বিষয়ে বলে কোন ফল হয় নি। তাঁরা বলেন, সামনে এখন নানা সমস্যা- বাস্তুহারা সমস্যা, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এমনি আরো কত সমস্যা, এ সবের জন্যেই ব্যস্ত তাঁরা। তবু সব সমস্যাকে সমাধান করবার জন্যে আমার অনুরোধ, শিক্ষা বিষয়ে সচেতনতা জাগ্রত করতে হবে। আর তা প্রথমেই অর্জন করতে হবে শিক্ষকদের। অর্থের বিনিময়ে এটা একটা কাজমাত্র নয়। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত তাঁদের হাতে। তাদের ভালোবেসে, তাদের বড়ভাই-এর আসন অধিকার করে আদর্শের পথে তাদের নিয়ে যেতে হবে। জানি বড় কাজ করার সুযোগ পান না আমাদের শিক্ষকরা। কিন্তু ছোট ব্যাপারেও তো আমাদের কিছু করবার আছে। যা সত্যরূপ সে বিষয় যদি আমরা দৃষ্টি দিই এবং ছেলেমেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি, তাহলে দেশের ও সমাজের অনেকখানি কল্যাণ সাধিত হবে।

ছবি সূত্র: niehs.nih.gov

তথ্যসূত্র : বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ

Comments

Popular posts from this blog

টাইম ম্যানেজমেন্ট

চিন্তার বিষয়

সব আমি করেচি! আমি!