লখনউ থেকে মেটেবুরুজ হয়ে চাঁদনি চক
ছোটবেলা থেকে সবাই শুনে আসছি, মিথ্যে কথা বলতে নেই। তবুও বিপাকে পড়ে সবাইকেই মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু দিনে দুপুরে গুচ্ছের মিথ্যে কথা বলতে পারে যারা, তারা সব নানারকম লাল নীল হলুদ সবুজ রাজনৈতিক দলের নেতা। এবছর কলকাতায় গরম পড়েছে বেজায়! গরমের চোটে, একটু বেলা বাড়তে না বাড়তেই রাস্তার কুকুরগুলো লুকিয়ে পড়ছে ছায়া খুঁজে। ধুনুরিরা বেরোচ্ছে না তুলো ধুনতে। বিহারী রিকশা ওয়ালা দুপুর হতেই ডেলা করে মাখা ছাতু খেয়ে গা এলিয়ে দিচ্ছে ছায়াতে। আর লোকসভা ভোটের দৌলতে সেসব হলদে সবুজ ওরাং ওটাঙের দল এই গরমে মাইক বাজিয়ে চেঁচামেচি শুরু করেছে। এইরকম গরমের দুপুরবেলা ঘরে বসে নেতাদের চেঁচামেচির চোটে বসে মন দিয়ে কাজ করার জো নেই। অগত্যা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়াই সমীচীন বলে মনে হল। রাস্তা সম্পূর্ণ শুনশান। সূর্যের তেজ আমার কালো ছাতা ভেদ করে ঝলসে দিচ্ছে চামড়া। বউবাজার পার হয়ে একটা গলির ছায়া ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে পৌঁছে গেলাম। রাস্তায় গঙ্গাজলের কল থেকে আগ্নেয়গিরির মত হুড়োহুড়ি করে জল বেরিয়ে আসছে। সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে ঘোর লেগে যায়। একটা কাক সেই জলে কখনও ঠোঁট দিয়ে জল তুলে, কখনো মাথা ডুবিয়ে নানান কায়দায় চান করছে বা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। গণেশ অ্যাভিন্যু ধরে আগুনের মত গরম বাতাস এসে পুড়িয়ে দিচ্ছে হাত পা। যখন করার মত কিচ্ছু থাকে না, তখন কেন জানি না শুধু খিদে পায়! খানিকক্ষণ কাক-চান দেখে, কী খাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে আবার হাঁটা শুরু।
হিন্দ্ সিনেমার পাশেই একটা লস্যির দোকান। গরমে লস্যি দেখে সেদিকেই মন গেল। কিন্তু দইয়ের ওপর মাছি ভ্যানভ্যান দেখে আর ভক্তি হল না। অগত্যা রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা কোল্ডড্রিঙ্ক কিনে একটা চুমুক দিয়েছি কি দিইনি; হঠাৎ পিছন থেকে সেই চেনা গলায় ডাক, "হেঁ হেঁ ফেলুবাবু! আছো কেমন?"
কোনো মতে বিষম খাওয়া থেকে বেঁচে আমি বললাম, "একি আপনি! এখন!"
তিনি ধুতির কোঁচা দিয়ে ঘাড় আর গলার ঘাম মুছতে মুছতে শুধু খানিক হাসলেন।
তুলসীবাবু'কে আমি শুধু শ্রদ্ধা করি তা নয়, অন্তর থেকে ভালোবাসি। ঘটনাচক্রে, আমার প্রপিতামহের নামও ছিল তুলসী চরণ। কিন্তু এই তুলসীবাবু আমার প্রপিতামহ নন। তবে তাঁরই প্রায় সমবয়সী। কোল্ডড্রিঙ্কের খালি বোতলটা নামিয়ে রেখে চলতে লাগলাম আবার। তুলসীবাবু মানে তুলসী চক্রবর্তীও হাঁটতে লাগলেন। উনি ঘামে জবজবে বড়সড় একটা ময়লা পাঞ্জাবী পরেছেন। আমি কোল্ডড্রিঙ্ক খাওয়ানোর জন্যে সাধাসাধি করেও রাজি করাতে পারলাম না। সশেব্দ উৎকট ঢেঁকুর ওঠার ভয়ে উনি বোতলবন্দি এই বিশেষ পানীয়টা দেখলেই তড়াক করে ওঠেন। খানিকক্ষণ হাঁটার পর গড়পড়তা কথা ফুরিয়ে গেল। তারপর খানিকক্ষণ পরে উনি বললেন, "আচ্ছা ফেলুবাবু, তুমি কত্থক নাচের কথা জানো?"
কত্থক নাচের কথা সবাই শুনেছে মোটামুটি। আমি হ্যাঁ বললাম।
তুলসীবাবু তড়াক করে প্রতিপ্রশ্ন করলেন। "তবে বলো দিকিনি, কত্থক নাচের কথা এই যে তুমি জানো.. এর জন্যে কে দায়ী?"
এর কী উত্তর আমার জানা নেই। আমার মুখ দেখেই উনি বুঝে গেলেন।
উনি হেসে বললেন, "শোনো। একটা চমৎকার খানা পাওয়া যায় কলকাতায়। তুমি খেয়েছো অবশ্যই। তবে এই দোকানে খাওনি কখনও।"
আমি বললাম, "কী দোকান?"
তুলসীবাবু বলতে শুরু করলেন, "এই কত্থক নাচ এখন যেমন সরেস, আঠেরো শতকের মাঝামাঝি তেমনটা ছিল না। অনেক সাদামাটা একটা নাচ ছিল। তারপর আউধের ওয়াজিদ আলি শাহ্ ছিল বেশ রসিক মানুষ। তারই চেষ্টায় কত্থক নাচে কত কী কায়দা জুড়েছে! আর সেই জন্যেই সেটা এত বিখ্যাত!"
আমি হাঁ করে শুনছিলাম।
উনি বললেন, "বিশ্বাস হল না! আমায় বলেছিলেন কে জানো?"
"কে? সত্যজিত রায়?"
"হেঁ হেঁ.. আর কে অতো জানবে বলো!"
আমি বললাম, "সবই ঠিক। কিন্তু এই গরমে আপনার এই নাচানাচি নিয়ে আলোচনা করতে ভাল্লাগছে?"
হাঁটতে হাঁটতে আমরা কখন চাঁদনি চকের ঘিঞ্জি এলাকায় ঢুকে পড়েছি, খেয়ালই নেই। তুলসীবাবু বললেন, "এই যে দোকানটা দেখতে পাচ্ছো! এইখানে চলো একটা জিনিস খাই। খেতে খেতে বাকিটা বলছি।"
আমি পড়লাম, ইংরাজিতে লেখা আছে সাব্বির হোটেল।
মুখে চোখে জলের ছিটে দিয়ে, পাখার তলা দেখে মুখোমুখি চেয়ারে দুজন বসে পড়লাম। উনি অর্ডার দিলেন দুটো বাটার নান্ আর দুটো মাটন রেজালা। তারপর আবার গল্প শুরু করলেন তিনি। "সেই ওয়াজিদ আলি শাহ্ ছিলেন আউধের শেষ নবাব। তিনি রাজকার্যে মনোযোগ দিতে পারছেন না বলে রাজত্ব চলে যায়। তখন তল্পিতল্পা গুটিয়ে ওয়াজিদ আলি চলে যান প্রথমে কানপুর। তারপর সেখানেও মন বসেনি বলে, একদম ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন, নাচিয়ে-গাইয়ে রাঁধুনি এমনকি পশুপাখির দলশুদ্ধু নিয়ে চলে আসেন আমাদের কলকাতার মেটেবুরুজে!"
ততক্ষণে দুপ্লেট ঈষদুষ্ণ মাটন রেজালা আর ইয়াব্বড় বাটার নান এসে পড়েছে। আমি গরম রুটি ছিঁড়ে রেজালার রসে ডুবিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম! রেজালায় চুবিয়ে নান্ খেয়ে তুলসীবাবুও তৃপ্তি পেলেন। তারপর আবার আমরা ফিরে গেলাম আঠেরো শতকের মেটেবুরুজে।
তুলসীবাবু আবার শুরু করলেন। "এমনিতে আউধের সঙ্গে মুঘলদের সুসম্পর্ক ছিল। তখন সুসম্পর্ক বজায় রাখতে রাঁধুনি বিনিময় হত। সেই সূত্রেই মুঘল সাম্রাজ্যের কিছু পাকা মোগলাই রাঁধুনি ওয়াজিদ আলির রসুই গন্ধে ভরিয়ে দিত। ওয়াজিদ আলির সঙ্গে তারাও লখনউ থেকে মেটেবুরুজ চলে আসে। সেই মোগলাই রাঁধুনিদের হাতেই কলকাতায় প্রথম তৈরী হয় রেজালা! আর এই সাব্বির হোটেল উনিশশো আটচল্লিশ সালে কলকাতার প্রথম রেজালা দোকান হিসেবে পথ চলা শুরু করে"
গল্প শুনতে শুনতে কখন আমাদের রেজালা নান্ সব ফুরিয়ে গেছে খেয়াল করিনি।
দোকানের ম্যানেজার তুলসীবাবু'কে দেখেই তড়িঘড়ি এসে সেলাম ঠুকে গেল! পয়সা তো নিলেই না; উপরি আবার জোর করে দু'প্লেট ফিরনি আর দু'প্লেট শাহী টুকরা দিয়ে গেল! আমি কিছুই না করে খানিকটা খাতির পেয়ে গেলাম! খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা হাঁটতে লাগলাম হ্যারিসন রোডের দিকে। তুলসীবাবু একটা পান মুখে পুরলেন। রোদ পড়ে গেছে ততক্ষণে। গরম না কমলেও বেশ বিকেলের বাতাস বইছে ফুরফুর করে। তিনি হেসে বললেন, "এই যে ম্যানেজার শাহী টুকরা খাওয়ালো, ওটা কিন্তু রুটি ভেজা! ঘন্টা খানেক রুটির কুঁচো দুধে ডুবে ঢোল হয়ে গেলেই ক্ষীর-টির দিয়ে জিনিসটা হয়! আর ওটাও কিন্তু কলকাতার নয়। ওটা পাক্কা লখনউ থেকে আমদানি! সুখাদ্যে মন পেট সব টইটম্বুর। মনে বেশ ফুর্তি নিয়ে দুজনে গলিঘুঁজি ধরে হ্যারিসন রোডে পড়লাম। তুলসীবাবু হঠাৎ বললেন, "এই দেখলে! কেমন ভুলে গেছি!"
আমি বললাম, "কী?"
তিনি হেসে বললেন, "শোনো, এই যে বিরিয়ানিতে আলু ছাড়া চলে না! সেই বিরিয়ানির হাঁড়িতে আলুর প্রবেশ কে করালো? ওই সেই ওয়াজিদ আলির রাঁধুনিরা!" তারপরই এই এই বাস বলে হন্তদন্ত হয়ে রামরাজাতলার একটা বাসে উঠে পড়লেন উনি। আমি আবার একা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে।
কৃতজ্ঞতা:
Comments
Post a Comment