অসমাপিকা

প্রেম এসেছিল কি না বলা মুশকিল। কিন্তু নারীসঙ্গ অন্তত একবার হলেও এসেছিল আমাদের তিনজনেরই জীবনে। তাই রাগ, অভিমান, প্রেম, প্রতিহিংসা প্রভৃতি সবরকম অভিব্যক্তির মেয়েলি রূপই আমাদের স্পর্শেন্দ্রিয়ের পরিচিত।
বাকী দুজনের কথা জানি না, তবে যে আমার চোখ হাত বেঁধে, হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলছিল, তাকে বিশ্বাসের কোনও প্রশ্নই ওঠে না বটে, তবে দুম করে অবিশ্বাস করাও যায় না।
চোখ আর হাত বাঁধা অবস্থাতেই ওরা আমাদের টেনে তুলতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। আমরা তো কারুর কোনও ক্ষতি করিনি, তবে কেন এরকম দুর্ভোগ!
সিঁড়ি শেষ হতেই, বিরাট একটা দরজা খোলার শব্দ হল।
হাঁটাচলা অস্বাভাবিক হলেও মস্তিস্ক হয়ে উঠছিল প্রচন্ড সজাগ। প্রাণভয় আর উত্তেজনায় গা ভরে ইন্দ্রিয়েরা সজাগ হয়ে উঠেছিল।

এই বেড়ানোর পরিকল্পনাটা আমারই। পকেটে পয়সাও ছিল না বিশেষ। সঙ্গে যে দুজন ছিল, খানিকটা তাদের কাঁধে বন্দুক রেখেই লখ্নৌ বেড়ানোর সাধপূরণ।
দুজনেই প্রতিষ্ঠিত। ছুটিছাটা পেলেই একজন ক্যামেরা নিয়ে বেরোয়। আর একজন মেজাজ ঠিক থাকলে, অনায়াসেই লিখতে পারে মসৃণ চন্দনবাটার মত ঝকঝকে কবিতা।
আমার পা টলছে অসম্ভব রকম। মনে পড়ছে, আমার ফোনটা বেশীদিন হয়নি এখনও। সেটা ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছি সেই দোকানেই। আমার ছশো টাকা আর একটা এটিএম কার্ড তখনও পকেটে ছিল। তাছাড়া আমাদের তিনজনের মোট অন্তত হাজার পাঁচেক টাকা ছাড়াও ছিল গোটা পাঁচেক এটিএম কার্ড।
আমরা এগোতে চাইনি; বাধা দিয়েছি প্রাণপণ। কিন্তু ওরা সংখ্যায় ছিল অনেক আর ওদের স্নিগ্ধতার অসামঞ্জস্য গায়ের জোরের কাছে পরাজয় স্বীকার করা ছাড়া উপায়ও ছিল না কোনও।
খোলা দরজাটা পেরিয়েই আমাদের একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হল মেঝেয় পাতা মোটা গালিচায়। মেয়েলী অট্টহাস্যে ভরে গেল গোটা ঘর। তারপর দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল শব্দ করে।
তারপর সব চুপ।

চেনা ছোঁয়ার সেই হাতটাই খুলে দিল আমার হাত, চোখ। দেখলাম, আমরা একটা বিরাট ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। অবিশ্যি সে ঘর, আমাদের কলকাতার ফ্ল্যাট কিম্বা বাড়ির চুনসুড়কির রংখসা ঘর নয়। সে ঘরের খোলা জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া হইহই করে ছুটে এসে ব্যার্থতাও মুছে নিয়ে চলে যায়।
দেওয়ালে বহুকালের সেজের আলো। চারিদিক পরিষ্কার অথচ সোঁদা গন্ধে ভরা। আমার পাশেই বসে মাত্র একজন পরমা সুন্দরী। আমার পাশে বাকী দুজনও বসে। আমরা একে অপরের দিকে চোখাচোখি করেই খানিক সুখ পাই। অন্তত তিনজনকে একই ঘরে আনা হয়েছে, এটুকুতেই আরও অনেকটা শান্তি।
প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতেই আটকে দিল মেয়েটা। ওদের পাশেও এক একজন করে বসে। সম্ভবত যথাক্রমে এদের পেশীবলে আবদ্ধ হয়েই এতদূর আসা।
অচেনা অথচ এরকম সুন্দরীদের পাশে মদ্যপ অবস্থায় বসে থাকলে, কখনও কখনও নিজেকেই ম্যানিকুইন বলে মনে হয়।
আমাদের গা দিয়ে নিশ্চই রাস্তার সস্তা সেই মদটার গন্ধ ভকভক করে বেরোচ্ছে। আমরা আমাদের ঘামে ভেজা জামার চেয়েও শালীনতা নিয়ে তটস্থ।
কবজির বাঁধা জায়গাটা গাঢ় দাগ বসে আছে। জাফরী পেরিয়ে জ্যোত্‍স্না এসে পড়ছে ওই দাগেই।
নতমস্তকে বসেও আড়চোখে দেখতেই হচ্ছে আমার পাশে বসা মেয়েটির দিকে। চশমাটা খসে গেছে দোকানেই, দৃষ্টি বেশীদূর যায় না। ওর নির্মেদ সুদীর্ঘ উজ্জ্বল শরীরটা, বহুযুগ ধরে কোনও ইতালীয় ভাষ্করের সৃষ্টি যেন। ওর কোমরের ভাঁজেও গাঢ় সাবেকিয়ানার ছোঁয়া।
চিকনের গাঢ় সবুজ ঘাগরায় আবৃত ওর কোলে শুধু একবার মাথা রাখতে ইচ্ছে হয়।
একটু আগেই যে বাজপাখীর মত ঝাঁপিয়ে আমার হাতদুটো বেঁধে, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এল এখানে, সে ই এখন পরম মমতায় বহু পুরনো কারুকাজ করা কাঁচের পাত্রে খানিকটা তরল ঢেলে দিচ্ছে। চেয়ে দেখি, আমাদের তিনজনের সামনেই একই পাত্র রাখা। একজন আমার মতই বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে বসে। আর একজন শুয়ে পড়েছে তার পাশের মেয়েটিরই কোলে।
ঘরে হঠাত্‍ তবলার কানায় দু'ঘা শব্দে গোটা ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। এতক্ষণে চারিদিকটা দেখার কথা মনে হল। চশমাহীন দৃষ্টি যদ্দুর যায়, ঝাপসা কয়েকজন বসে। তারা সকলেই নারী অথবা কোনও নিঁখুত তৈলচিত্র। তানপুরার তারে কয়েকবার সুর খুঁজছে কেউ।
মেঝেতে রাখা গেলাসের তরলটা হয়ত মুঘল আমলের কোনও সুরা কিম্বা সময় কিম্বা অতি প্রচন্ড বিষ! মাথা ভারী হয়ে আসে ক্রমশ। অবশেষে সমস্ত দ্বিধামুক্ত হয়ে, মাথা রাখি চিকনের গাঢ় সবুজ কোলে।
কোল কখনওই শরীর হয়ে উঠতে পারে না। নড়বড়ে সাঁকোর মত ঋতুতে সমানুপাতি জলের গভীরতা যাপন করে।
ওর শরীরের একটা মিশ্র সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে; সেটা হয় চন্দন কিম্বা আতর কিম্বা সমগ্র বিশ্বটাই!
আমার মত আমার অচেতন শ্বাসও ওর কোলের উষ্ণতা আর বুকের ছন্দবদ্ধ ওঠানামায় স্বচ্ছন্দ খুঁছছে।
গেলাসের তরলের মিষ্টি গন্ধটা ক্রমশ আমার সস্তা উগ্রতাটুকু ঢেকে সভ্য করে, ঐ প্রাচীন মহলের মানানসই করে নিচ্ছে। রূপোর আতরদান থেকে খেলার ছলে, মিহি আতর ছড়িয়ে দিচ্ছে নতুন এই সভ্যতায়।
ওর বিরাট চুল খোলা পিঠের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে কোলে, আমার মুখের কাছে।
কোলে মাথা রাখার অস্বস্তিটা ওর সরল সততাকে গ্রাস করেনি। হয়তো এরকমই কথা ছিল। চিরকালীন হওয়ার ফুরসতটুকুও পাবো না; জানি বলেই যতটুকু পাই, ততটুকুই পরিপাটি করে রাখা। আর একটু একটু মুহুর্ত জুড়েই তো এই মহাজীবন।

ছবি সূত্র: India Today

Comments

Popular posts from this blog

টাইম ম্যানেজমেন্ট

চিন্তার বিষয়

সব আমি করেচি! আমি!