দুঃখ বিহীন দুঃখ

এবারের গরমে আধমরা হয়ে গেছে সবাই। গরমের চোটে কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। আমার মাথাটা বাকিদের মাথার চেয়ে বড়। তাই নিয়ে ইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই সহপাঠীরা হাসিঠাট্টা করে অতিষ্ঠ করে তুলতো। এখন সেই বিরাট মাথায় ততোধিক বড়বড় চুল হয়ে আরও গরম লাগছে। এই গরমের ওপর শনিবার, তাও আবার কলকাতায় ভোটের আগের দিন- সব মিলিয়ে রাস্তাঘাট ফাঁকা। কখনো কখনো দল বেঁধে ক্যামোফ্লাজ পোষাকের মিলিটারি শহর বেড়াতে বেরিয়েছে। সবাই বেশ লম্বা, কয়েকজনকে দেখে কাশ্মীরি বলে মনে হয়। ঘরের গরম কাটিয়ে আমি চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি। কারমাইকেল হস্টেল থেকে কালো টি শার্ট পরে জনা চারেক ছেলেও চা খেতে এসেছে। ওদের চা খাওয়ার ধরণ দেখে মনে হয় ওদের খুব তাড়া; সম্ভবত পরীক্ষা। ওরা সবাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র। চায়ের দোকানের গায়েই একখানা বটগাছ। তার তলাতেই বসার ছোটো বেঞ্চি। সন্ধ্যে আর নেই, বা রাত হবে বলে তাড়াহুড়ো করে ডিউটি শেষ করে ফেলার তাল করছে। যারা চা খাচ্ছে, সবারই বাড়ি ফেরার তাড়া। কেউ বসছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। অসাবধানী চুমুকে ছ্যাঁকা লাগছে, ঠোঁটে ঠোঁট বুলিয়ে আবার হুড়োহুড়ি করে চুমুক দিচ্ছে সবাই। তারপরই সবাই ভীড় ট্রেনে মিলিয়ে যাবে অন্ধকারে। মফস্বলি স্টেশনের সাইকেল স্ট্যান্ডে সাইকেল জমা রেখেছে কেউ। যে যার মত ফিরে যাবে যখন খুশি! মাটির ভাঁড়গুলো পড়ে থাকবে মাটিতে, কোনোটা  গোটা, কোনোটা বা অল্প ভাঙা আবার কোনোটা একেবারেই খানখান হয়ে যাবে।

আমার চা ফুরিয়ে গেছে। হ্যারিসন রোড বেয়ে হাওয়া বইছে হুহু করে। ঠান্ডা হাওয়া। এমন সময় বাঁ হাতে এক গোছা বেলফুলের মালা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো এক বালিকা। তার বয়েস বড়জোর আট কিম্বা দশ। ড্যাবড্যাবে চোখে চেয়ে বলল, "কি গো! মালা নেবে?"
আমি শুধু ঘাড় নাড়লাম।
সে আবার বেশ তীব্র ঝাঁজ নিয়ে বলল, "কি গো! তুমি মালা নেবে না কেন?"
আমার একটু হাসি পেল। বাচ্চা মেয়ে। জামাটা অপরিষ্কার হলেও পরিপাটি করে পরেছে। মাথায় দুটো মাঝারি বিনুনি। সেগুলো তার কথার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নড়াচড়া করছে। আমি বললাম, "কেন নেবো?"
সে তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, "আমি বিক্কিরি করছি বলে!"
আমি এবার সত্যিই বিমর্ষ হয়ে বললাম, "দেখ আমার কোনো ঠাকুর নেই। মালা নিয়ে কী করবো বল!"
বালিকা শুনে বললো, "কেন গো! তোমার বউকে পরাবে!"
আমার এবার সত্যিই খুব হাসি পেল। বললাম, "না রে, আমার তো বউ নেই!"
সে তার কোমর ধরে অবাক হয়ে বলল, "সেকি গো! তুমি বিয়েই করোনি! তবে তুমিই পরো!" বলে, নিজেই একটা বেলফুলের মালা আমার বিরাট মাথা দিয়ে গলিয়ে দিতে গেল। হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে মালাটাই ছিঁড়ে ফেললো!
আমি হকচকিয়ে গিয়ে মালাটা খুলে কিছু বলতে যাচ্ছি, সে আমার কথা কেড়ে নিয়ে বললো, "এবার দাও দশ টাকা"
আমার এবার রাগ হলো। বললাম, "তুই মালা পরিয়ে দিলি। তার জন্যে আমি টাকা দেবো কেন?"
সে বলল, "সেকি গো! মেয়েরা আবার টাকা দেয় নাকি! তুমি দাও।"
আমার আর কিছু বলার নেই। বললাম, "চা খাবি?"
সে চা খায় না। বিস্কুট খেলো। তারপর দশ টাকার নোটটা সালোয়ারের গায়ে লেপ্টানো একটা কাপড়ের ব্যাগে ভরে শিয়ালদার ভীড়ে মিশে গেল। গুগল বলছে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই বৃষ্টি নামবে, কালবৈশাখী ঝড় আসবে। এইটা শুনেই আরাম লাগছে। ঝড়ে হয়তো গেরস্থের পুরোনো চিলেকোঠার চালটা এলোমেলো হয়ে যাবে, কিম্বা ট্রামের তারে উপরে পড়বে বুড়ো অশ্বত্থগাছ। ট্রাম চলবে না, অনেক সমস্যা হবে। তবু গরমটা অল্প কয়েক মুহুর্তের জন্যে হলেও তো কমবে। তাই বা কম কিসে!


Comments

Popular posts from this blog

চিন্তার বিষয়

My letter to The Chief Minister of West Bengal

উত্তম মাধ্যম