খোসায় বিপদ

মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক স্তর যাঁরা বাংলা বোর্ডের আওতায় ছিলেন, তাঁরা সম্ভবত মনে করতে পারবেন ফিজিক্স কেমিস্ট্রি অঙ্ক যে বই হোক না কেন, বাংলা ইংরাজিতে উচ্চমাধ্যমিক অবধি, হলদেটে কমলা রঙের সরকারি বই-ই কিনতে হত (এখনকার কথা আমার অজানা)। এই স্তরে আমার অদ্ভুত একটা রোগ ছিল; বই কিনেই ঠিক যে যে গল্প, গদ্য আর নাটকগুলো সিলেবাসে নেই, সেইগুলো সবার আগে নাওয়া খাওয়া ভুলে পড়ে ফেলা। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তৎকালীন ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ বিহীন জীবনে এই রোগে আক্রান্ত হয়নি এরকম ছাত্রছাত্রী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সরকারি বইয়ে সিলেবাসের বাইরের গল্প পড়ার যা স্বাদ ছিল, তা এমনি আলাদা করে গল্প বই পড়ায় ছিল না। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, মাধ্যমিক পাস করার পরই, গল্প পড়ার লোভে আর বই ফুরিয়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে আগেভাগেই উচ্চমাধ্যমিকের পাঠসঞ্চয়ন আর হায়ার সেকেন্ডারি ইংলিশ সিলেকশান মিলিয়ে মোট পাঁচটা বই কিনে ফেলি। কবিতা ও নাটকের বইতে উৎপল দত্তের নাটক নীলকন্ঠ পড়েছিলাম প্রায় আট বছর আগে। আজ সত্যেন বসুর অনূদিত একটা গল্প পড়তে পড়তে সেই নীলকন্ঠ নাটকের কথাটা মনে পড়ে গেল! এই অনূূদিত গল্প আর নাটকের থিম অবশ্যই আলাদা। তবুও প্রতি পদে পদে যেন একই বক্তব্য প্রকাশ পায়!

শুধু বাংলা নয়, আজকের ভারতে সমাজ রাজনীতির যা পরিস্থিতি, তাতে এই অনূদিত গল্প খুবই প্রাসঙ্গিক। তাই বিজ্ঞানী সত্যেন বসু নয়। আজ বরং অনুবাদক সত্যেন বসুর কথা লিখি। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের একটি সঙ্কলন থেকে, ফাল্গুন ১৩৭৩ সংখ্যায় দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অনূদিত খোসায় বিপদ গল্পটা সরাসরি রইলো।

‌‌~~~~~~~~~~~~~

[ইহুদি লেখক স্যামুএল জোসেফ অ্যাগনান ১৯৬৬ খৃস্টাব্দে নোবেল প্রাইজ পেয়ে যশস্বী হয়েছেন। এঁর লেখা থেকে একটি সংকলন ১৯৫৯ খৃস্টাব্দে 'জেরুজালেমের গল্প' বলে ফরাসী ভাষায় পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়োছিল। গল্পগুলি পড়ে বোঝা যায়, ভারতের বর্তমান সমস্যার সঙ্গে ইসরায়েলের নাড়ীর যোগ আছে। ওই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত “খোসায় বিপদ” (La Palure) গল্পটি মূল ফরাসি থেকে অনুবাদ]


রাস্তায় ফেলে দেওয়া এক কমলালেবুর খোসা। নিতান্ত সাধারণ রকমের- এর মত দশ বিশটা পথে, নর্দমায়, উঠানে, সর্বত্র-এ শহরে দেখা যার়। অন্যমনস্ক হয়ে চলতে উপরে পা পড়লে হড়কাবেই। তখন সভ্যভব্য সাবধানী থেমে নিরীক্ষণ করে জুতোর তলা কতটা পরিষ্কার রইল; আবার গম্ভীরভাবে-চলা শুরু করে৷ আর যারা খুব বেহুঁশ তারা পা টেনেই চললো যেন আর কোন অসুবিধা নেই। সাত জোড়া চোখ থাকলেও রাস্তায় যত খোসা পড়ে তাতো গুনে শেষ করা যাবে না। কাজেই খোসা নিজের স্থানে শাস্তিতেই রইল আর লোকেরা তার উপরে হেঁটেই চলেছে। খোসার উপর হড়কে একদিন এক বুড়ো পড়ে গেল। নিজের হাড় কটা টিপে গুনে সে আবার উঠে দাঁড়াল- চলে গেল সেখান থেকে। উপস্থিত অন্যদের বিচলিত হবার ভাব নেই। খানিক বাদে এক যুবতীর ভাগ্যে একই অঘটন। তার কোন অঙ্গহানি হল না, তবে হাতব্যাগটি খুলে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো নানা সরঞ্জাম। আরশি, চিরুনি, সোনার পাউডার বাক্স, লিপস্টিকের টিউব, নখ-পালিশের ছোট শিশি, পমেড, সুবাস ইত্যাদি।

একটি যুবক সব সরঞ্জাম কুড়িয়ে গুছিয়ে দিতে লাগল। খোসা কিন্তু সরঞ্জামের মধ্যে গণ্য নয়, তাই সে যথাস্থানেই পড়ে রইল। বেশ শাস্তিতেই আছে- বুঝছে না যে, সে যত নিন্দুক, হিংসুক, সংক্ষেপে রাজ্যের যত দুষ্ট-রসনার প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়েছে। খোসার দুষ্ট স্বভাব নিয়ে নিন্দা শুরু হল। লোককে বিপদে ফেলতেই যেন এর আনন্দ। নিজে নড়ে না, আর শহরবাসীদের অপকার করেই চলেছে। অথচ কেউ ভাবছে না তাকে দুরে সরায়। এই ক্রূর অসংযত ভাষণেই লোকেরা ক্ষান্ত হলো না- ক্রমে হিংসা ও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সঙ্গীদের উপর আক্রমণ সুরু হলো- যারা দেশের ও বিশ্বের মধ্যে যত অঘটন ঘটছে, তার কোন খেয়াল করে না— শুধু নিজেরা চুপচাপ, নির্ভাবনায় বসে থাকে।
খােসার তবে কপাল ভাল! কার্যকারণ থেকে পৃথক করে দেখে, দেশে এরকম শান্ত, শিষ্ট, চিন্তাশীল লােকেরও অভাব নেই। তারা সদয়ভাবে পরীক্ষা করে সবদিক, আসামীর পক্ষে বলে- “যা কিছু ঘটেছে , তার জন্য তােমরা কেন খােসাকেই দায়ী করছ? যে সব অশিক্ষিত বর্বরেরা সব সময় আমাদের দেশের মাথা হেঁট করছে, তাদের মধ্যে কেউ একজন খােসা রাস্তায় ছড়িয়েছে , প্রকৃতপক্ষে তাকেই দোষী বলতে হয়। শুধু কমলার রস পেটে পুরে খেয়েই ক্ষান্ত হয় নি, সব খোসা সারা রাস্তায় ছড়িয়েছে- ফলে, এইভাবে দেখ, দেশে দুর্বলের ও আহতদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।”

বুদ্ধিমানদের এই অভিমতে সারা দেশের লােক কিন্তু সন্তুষ্ট হলাে না। যারা ভাবে, বুদ্ধি ও চিন্তার বিষয়গুলি যতটুকু রাজনীতির মধ্যে এসে পড়ে ততটুকুই তার দাম, তারা এর সঙ্গে রাজ্য সরকারের অতীত ও ভবিষ্যতের নানা ভুলভ্রান্তির কথা তুলে সমালােচনা শুরু করলেন। এতেই নিরস্ত হলেন না, শেষে খােসার দুষ্কৃতির সব দায়িত্ব চাপালেন শহরের মিউনিসিপ্যালিটির উপর। কারণ, ওখানকার আবর্জনা সরাবার বিধিব্যবস্থা একান্ত নিন্দনীয়। তাঁরা গাইলেন- যে লােক কমলার খােসা ছড়িয়েছে তাকে দোষ দিয়ে লাভ কি? সে তাে কমলাটি খেয়েছে, বস্তুত ভাল কাজই করছে সে। বাহিরের আমদানি পণ্যের বদলে দেশের উৎপন্ন ফল থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করা কি অনেক ভাল কাজ নয়? সত্য সত্যই সে তাে নাগরিক হিসাবে প্রশংসার পাত্র। ভগবান যেন অন্য সকলকে তার অনুরূপ দেশানুরাগী করেন। যদি আমাদের দেশের সকলে স্বদেশী জিনিসে সন্তুষ্ট থাকত বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি চাইত না, তা হলে সরকার বিদেশী অর্থব্যয়ে অনেক সাশ্রয় করতে পারত। এ শেষ কথা, মিউনিসিপ্যালিটিকে দোষ দিতেই হবে কেন সে শহর পরিষ্কার করতে যথেষ্ট ঝাড়ুদার নিযুক্ত করে না। এতে তার কি হচ্ছে। ট্যাক্স আদায় করে পয়সা বাঁচাচ্ছে। আর আমাদের দিচ্ছে পয়সার বদলে কলা ও কমলার খােসা। সরকারের বুঝি একটিমাত্র কর্তব্য- খালি ট্যাক্স বাড়ানাে, পরিবর্তে দেশবাসীকে সে কি কিছুই দেবে না? যখন এই সব তর্ক, নালিশ ও দোষারােপ চলছে— একজন পথ চলতে সেই সব শুনল। আপন মনে চেঁচিয়ে বললে, “বেশ তাে! এইবার ট্যাক্স আদায় করতে কেউ এলে তাকে ঠেলে ফেলে তার নাকের ওপর দরজা বন্ধ করব। মাসুল না দিয়ে যা বাঁচাব তাতে আচমকা- আঘাত থেকে আত্মরক্ষা হিসাবে এক বীমা করব। সেদিনও বেচারী বৃদ্ধটি খােসার ওপর হড়কে পা ভেঙেছে— তার মত আমাকে রিক্ত হস্তে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে না।"

এই কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষিব্যাঙ্ক - সংস্থার প্রচারক একজন তাকে ডাকলে। অনুরােধ করলে তার ব্যাঙ্কে পয়সা খাটাতে। এ কোম্পানী কিনছে পতিত জমি, তবে চাষ না করেই পতিত রাখবে অথাৎ তাতে কমলাও জন্মাবে না, লােকে কমলা খেতে পাবে না, অতএব খােসার ওপর বেশী করে হড়কে পড়বে না। যে লােকটি এতক্ষণ ট্যাক্সের হুঙ্কার দিচ্ছিল- সে এখন একেবারে উত্তেজিত হয়ে উঠলাে- "যেই ব্যবসায়ে লােকসান হল অমনি কৃষিব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা এসে আমার পুঁজির দিকে তাক করছেন। বাবা এদের দেহি দেহি না শুনলে দিন কাটতে চায় না। উৎসবেই বা অনশনেই বল, Pague হউক কি নববর্ষের দিনে , কোন জয়ন্তী বা কোন বার্ষিকী, এঁদের বাদ দিয়ে যাবে না। এঁরা উপস্থিত; বলেন পুঁটুলি খােল। হা ভগবান, বৎসরের মধ্যে কি একটা দিনও সৃষ্টি হয়নি যাতে আমার কাছে কেউ টাকা চাইতে আসবে না? মনে হচ্ছে , যে সব দিনে মনিব্যাগ খুলতে হয়, গুনে দেখলে তা পাঁজির তিথির সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে।
  মশায়, কত দিচ্ছেন আমাকে? প্রচারক জিজ্ঞাসা করে।
    দাও ! দাও !
    আপনার নামে কত শেয়ার লিখবাে?
    কী ? আবার কত ! আপনাদের কী আমি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দিই নি । বিশ্বাস করুন, বুঝুন; সে আবার আজকেই হীনমুল্যের টাকা নয়– কি বলবাে- যা বের করে নিয়েছেন সবেতেই তাে সরকার লাভ করেছেন। আরও কি অভিলাষ? কেন এসেছেন? আমি কি আপনাদের কৃষিসংস্থার সঙ্গে ভিড়তে চাইছি? আর  জ্বালাবেন না আমি শান্তি চাই, আমি এখন কমলার খােসা নিয়ে ভাবছি।

এরকম বলা চলছে এমন সময়ে এক সরকারী কর্মচারীর পত্নী সেখানে উপস্থিত হলেন। 'কমলার খােসা!' চিৎকার করে বললেন- “আমার পােড়া কপাল। ভাবুন দেখি আমার শাশুড়ী এক কমলার খােসার ওপর হড়কে- বিশ্বাস হয় আপনার, না এ কথা আর বলবেন না যাচ্ছিলেন কোথায় জানিনে অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না, হ্যাঁ তখন হড়কে দুম - পটাশ। কমলার খােসা কী শরবতী লেবুর হবে বা না না বুঝি কলার খােসাই , দেখুন তাে বাঁ কি ডান পা ভাঙলেন । আর বলবেন না সে কি বিপদ! ভাবুন তাে সাতটা তােশক বালিশ লেগে গেল বিছানায় শুয়ে থাকতে। বুঝছেন কি দুভাগ্য। আর সেরে উঠেও ভাবতে পারবেন না কি গন্ডগােলই করছেন সকাল থেকে সন্ধ্যা, কেবল ওপর আর নীচ সব ঘর হাতড়ে বেড়াচ্ছেন আর খোঁড়াচ্ছেন, মেঝের ওপর লাঠি ঠুকে। কি যন্ত্রণা কি বলবাে? কি বিপদেই আছি আমি। মাঝে মাঝে ভাবি, এসব ফেলে পালাই। হায়, যদি পারতাম বিদেশ যেতে , অনেক দিন তাে এদেশ ছাড়তে পারিনি সেই শেষ কংগ্রেসের পর থেকে।'
কংগ্রেস শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কথাবাতা মােড় ঘুরল। তখন থেকে শুধু কংগ্রেসেরই কথা— এদিকে, এ খােসা রাস্তাতেই পড়ে। শত বুটের চাপে কলুষিত হচ্ছে। বেচারী তার তারুণ্য ও ঔজ্জ্বল্য সবই হারিয়েছে। এখন দাঁড়িয়েছে কোঁকড়ানো তোবড়ানো বিবর্ণ তুচ্ছ এইটুকু ছোট। তবু এক হিসাব তার সৌভাগ্যের জোড়া মিলবে না! এর সমজাতীয়েরা তাে অনেক দিন আবর্জনা বা সারের স্তুপে অন্তর্ধান করেছে। এর তবু খ্যাতির সঙ্গে পরিচয় হলাে . . .

ব্যাকরণের এক শিক্ষক থাকতেন সেই শহরে। ভাষায় সাধুপন্থী। লোকের কথা শুনে তার বাকরণ অন্বয়ের দোষ ধরে ধরে সেটা বদ্ধ অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। খােসা নিয়ে আলােচনা হলে শুনে, তার ভাষাশুদ্ধির কল্পনা কাজে লাগবার প্রবৃত্তি হলাে। প্রথমে সামনে যাকে পেলেন- দেয়ালের কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসার সুরে আরম্ভ করলেন-
      তােমার খোসার বিষয়ের মতটি কি খুলে বলাে তো?
      এ খােসা!- কি আর বলবাে আমি, এতাে অন্য সবের মতই দেখছি।
      ভায়া, আমার প্রশ্নটি তুমি বুঝতে পারনি।
      খােসা কি পদার্থ তা অনিবার আগ্রহ নয়। আমার, কথার সাধুরূপই আমার চিন্তা। বহু বৎসর ধরে আমি বলে আসছি - এর শুদ্ধ রূপ খোলা- এইপ লেখা উচিত। তা এই সব বেওয়ার দল, আমার কথা শুনবে না। তারা সব। সময় এই বলবেই, লিখেও চলেছে; সত্যি এসব একেবারে বন্ধ করা দরকার।
তখন সকলে সাধু ভাষা নিয়ে পড়লাে। যেটি কথার মধ্যে সার সেটি সহজেই। চাপা পড়ে। খােসার বেলায় তাই হলাে। তবে বলেছি তাে এ খােসার শুভলগ্নেই জন্ম তাই সব কথাবাত্রার মধ্যে কৌতুহলের কেন্দ্র হয়েই রইল। অভ্যাস দাঁড়াল লােকে তারই চারিদিকে জড় হয়ে সদ্য সদ্য ঘটনার উপর টিপ্পনী কাটে!

একজন একে প্রথম দেখেই বলে উঠলেন - আমার আশ্চর্য লাগে কেউ ভাবেনি এর ফটো কাগজে ছাপায়। বড় প্রেস-দের হাতে নেওয়ার এইতাে প্রকই সময়। প্রবন্ধ লিখে খােসার ছবি তােলার জন্য চাঁদা ওঠাবার কথাটা পাড়তে হয়। লােকে সব সময়েই মুক্তহস্ত, তারা ফটোগ্রাফারকে সাহায্য করবেই। তারাই, সাদার ওপর কালাে বুলিয়ে প্রমাণ করে দেবে, এটি শহরের লােকেদের যাতায়াতে কি বিঘ্নই ঘটিয়েছে। শুধু পয়সাতে কার্পণ্য করাে না। সত্যকার আর্টিস্টকেই এই কাজে লাগাও — সে ছবি তাে আমরা বিদেশেও বেচতে পারি? আমাদের যে শিক্ষা হচ্ছে তার ভাগ পাবে বিদেশী প্রতিবেশীরা, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এই সুন্দর দেশের ছবির তারিফ করবার আনন্দ তাে আছেই। তবে এই উদ্দীপনার মাঝখানে বাধা দিয়ে একজন বললেন— বেচারী একে কেন মিথ্যা নিন্দা করছেন? আমাদের দেশের কি ক্ষতি করছে এ খােসা। বরঞ্চ উল্টোটি ঠিক। এটি তাে আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক— এখানে যার যা খুশী করতে পারে, কোন বাধা নেই! শুনে একজন হেসে উঠলেন , কক্ষনাে শুনিনি, এটুকু শুধু বাকী ছিল হে। এ আমাদের স্বাধীনতাকে মূর্ত করেছে। কোথায় চলেছি আমরা? জাহান্নামে নয় কি?

তবে নিজের কথাও বােঝাবার সময় পেলেন না তিনি। তখনই এক বৃদ্ধ বাধা দিয়ে নিন্দা করতে লাগলেন (ইনি নিজের দেশের যেখানে ভাল কাজ হচ্ছে তার খােজেই তৎপর হয়ে থাকেন)। বললেন, কে আপনাকে জাহান্নামের কথা পাড়তে বলেছে? আপনি তাে আমাদের গ্রন্থ পড়েন নি - আপনি কি শিরটোপা? তা তাে না! তবে যারা ধর্ম সমীহ করে তাদেরই জাহান্নামের আলােচনা করতে দেন- এই সব নাঙ্গাশিবেদের স্পর্ধা দেখ! সীমা পরিসীমা নেই। বাইবেল টেনে নিয়েই ক্ষান্ত নয় তারা, বিশুদ্ধ তালমুদকেও দখল করতে চায়। লেখক সেই তর্কে যােগ দিয়েছিলেন, তবে ভয়ও হলাে এতে ঝগড়া বেধে শেযে হাতাহাতি না হয়। তাই শেষ অবধি ঠিক করলেন যে, দ্বন্দ্ব ও ঘৃণার উৎস এই খােসাকেই সরিয়ে ফেলি! ঝুঁকে তুলে সরিয়ে দিলেন। তখন, এক বৃদ্ধা পাশে ডেকে বলছেন- শহরে অন্য আবর্জনার বিষয় কি ভাবছেন?- করবেন কি? টুকরাে কাগজ, খবরের কাগজের পাকান মােড়া, সিগারেট-বিড়ির অবশেষ আরও কত কি আবর্জনা রাস্তায় ছড়ানাে — এ গুনে শেষ হবে না। এই কোণায় খােসার ঝুড়ি, এখানে শৱবতী লেবুর টুকরো- ওই দেখাে আবার কি, ছেড়া বই। সত্যি। কি আপদ। আন্দোলনকারীরা পুস্তিকা বিলােতে ছাড়বে না। সব সময় নাকে কানে গুঁজে দিচ্ছে আর রাস্তা তাে ছেড়া পাতায় ভর্তি! আবার এ কি সর্বনাশ! একটা ভাঙা জাঁতিকল আর মরা ইদুর। অসম্ভব অসম্ভব ব্যাপার, প্রলয়ের শেষ দিন পর্যন্ত ও এখানে পচবে দেখছি। একজন পথিক তাকে আশ্বাস দিলে- মা! শান্ত হও, এত ব্যস্ত হয়াে না। শীঘ্র দেশ তত ভাগ হতে চললাে! এখনাে জানা নেই কোনটা কার ভাগে পড়ে। বােধ হয় এই দিকটা শত্রুদের ভাগে পড়ছে। তা হলে এইসব আবর্জনা স্বস্থানে ফেলে রাখাই কি বেশী ভাল নয়? দেশভাগের কথা ওঠায় যেন বিপদের পাগলা ঘণ্টা বাজলাে। সকলে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাে- যে এই পরাজিত মনােভাব ব্যক্ত করেছে। তর্ক উঠলাে। কোলাহল। তাঁরা কি বলতে চান- সে কি কখনও বলেছে যে সে দেশভাগ চায়- শুধু কাগজে যা অবিরত ছেপে চলেছে তারই পুনরুক্তি করেছে। অন্য লােকেরা কিন্তু তাকে ধাক্কা মেরে বেশি চেঁচাতে শুরু করলে। লেখক ভাবলেন, শেষে দেশের ভাগ্যে যাই ঘটুক ভাগই হােক, কি একই থাক, বর্তমানের কথাই দরকারী সব প্রথম- নিজের দরজার সামনের রাস্তাটাও পরিষ্কার করি। তাই ঝুঁকে পড়ে আবর্জনা ঝাঁটাতে শুরু করলেন।

যেই রাস্তা পরিষ্কার করবার চেষ্টা অমনি সকলে তাঁকে নানা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে এলেন। কিভাবে সুন্দর করে ঝাঁট হয়। কি করে সব জড়াে করে তুলতে হয়। কোথায় বা ফেলা ভাল। শেষে একজন এলেন বলতে, কিভাবে সব পুড়িয়ে ফেলা উচিত। ওপরে আকাশও যেন এতে যােগ দিল। হাওয়া উঠলাে। যা কিছু মাটিতে উড়তে আরম্ভ করলো হাওয়ায় ফুৎকারে ছেঁড়া কাগজ বইয়ের পাতায় প্রবেশ করলো। এরা তো ফলের খোসার মত বস্তুমাত্রই নয়, পরিকীর্ণ আবর্জনা থেকে ভাবধারণার বাহক উঠে মুখে নাকে লাগতে লাগলো, আবার শেষে তুচ্ছ বস্তুর মতই মাটিতে পড়তে লাগলো। সকলের পরামর্শ একত্র করে লেখক সব সরিয়ে ফেলতে চাইলেন! তখন পরামর্শেও বিরোধ উপস্থিত হলো। লেখক কমলার খোসা তুলে আস্তাকুড়ে ফেলবেন, একজন বললেন, তুলুন প্রথমে শরবতীর খোসা। এসব তোলা হল, তখন আর একজন এগিয়ে এসে বললেন, কলার খোসা সরান সবার আগে। লেখক চেষ্টা করছেন সকলের কথাই শোনেন। কিন্তু মানুষের হাত বা কয়খানা- পরামর্শ আসছে তার থেকে অনেক বেশী। ভাল মানুষটি যত চেষ্টা করছেন, বিরোধী মতের সমন্বয়ে করতে ততবারই এই কাজে বিফল হচ্ছেন।

রাস্তায় অবিলম্বে লোক জড় হলো! ব্যস্ত হয়ে হাত নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করে তর্ক চলল- কোনটি প্রথম, পরে কোনটি ঠিক কিভাবে করা উচিত। তর্কের শেষ নেই। শেষ অবধি বিরক্তি। মন বিষাক্ত হয়ে হাতাহাতি শুরু হলো। এমন সময় একেবারে অতর্কিত আশ্চর্য ঘটনা! (লেখক স্বীকার করেছেন ঠিক এ রকম সব সময় হয় না) ঝগড়া-ঝাঁটি হয় লোকের মধ্যে এ তো চলতি ব্যাপার, বৎসরের সব দিনই হচ্ছে। তবে হঠাৎ যে সেখানে পুলিস এসে জুটবে এটা অঘটন; তবু ঘটে গেল। প্রমাণ হলো অঘটনও ঘটে। লোকে যখন মারামারি শুরু করেছে কোথা থেকে এক পাহারাদার এলো- ভীড় সরাতে শুরু করলে। কে তাদের অনুমতি দিয়েছে যে খোলা রাস্তায় এতগুলো নিষ্কর্মা লোকে জড় হয়ে ঝগড়া করছে। দেখেই বুঝলে নিষ্কর্মারা, প্রহরী ঠিক পরিহাস করতে আসেনি। তারা দ্রুত চম্পট দিলে। চারিদিক পরিত্যক্ত, লেখক শুধু একা দাঁড়িয়ে রাস্তার মধ্যে। ভাবলেন এইবার কাজ করা যাক, অন্য কেউ আর বাধা দিতে বা বিরক্ত করতে নেই।দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁট, ময়লা জড়ো করা সব পরিষ্কার কাজে লাগলেন লেখক, তাঁর খুব ইচ্ছে হয়েছে রাস্তাটির সুন্দর করে প্রসাধন করেন। একমাত্র লেখকই রয়ে গেলেন, পালান নি, এটি সন্দেহের কথা বলে ঠেকলো প্রহরীর কাছে। ডেকে বললো, দাঁড়াও, সব কথার উত্তর দাও ও সব কথা সত্য করে বলো। পরে ডায়ারি বের করে লিখলে নাম, তারপর জেরা শুরু হলো, যাতে যাতায়াতের এই অসঙ্গত অবরোধ ঘটল এবং অবশেষে এলো এত অযৌক্তিক দাপাদাপি। লেখক যথাসাধ্য নিজে সাফাই দিলেন। শপথ করে বলছি, দারোগামশায় আমি কিছু করিনি। এই খোসা আমার রাস্তায় পড়ে রয়েছে। বুঝলাম এ তো সব পথিকের বিপদ ঘটাতে রয়েছে, আর যখন কেউ একে সরায় না, ভাবলাম আমিই করি, তুলে ফেলে দিলাম একে। এই আরম্ভই যা কিছু শক্ত ঠেকলো- পরে এই রাস্তা পরিষ্কার করছি। এই-ই যা হয়েছে- সব শপথ করে বলছি। দাঁত চেপে শিস দিয়ে কঠিনভাবে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রহরী বললে- তা হলে তুমি স্বীকার করছো এই সব আবর্জনা ঝাঁট দিতে তুমি অংশ নিচ্ছিলে?
- এতো সোজা কথা, তা ছাড়া আমি তো কিছুই লুকাইনি- যা বলেছি একেবারে সত্য, আর একবার বলতে প্রস্তুত হলাম।

প্রহরী দেখতে চাইলে লেখকের কাছে মিউনিসিপ্যালিটির কোন নির্দেশনপত্র আছে কিনা যাতে আমাকে সেই কাজ করতে দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। তারা সব যা দেখলো ও শুনলো সব লিখে নিলে। শেষে তার বিরুদ্ধে একটি দুষ্কর্মের তালিকা লিখে ফেললে। আইন যা- তাই। ছাড়পত্র ছাড়া লেখক খেলাচ্ছলে ঝাড়ুদারি করতে পারে না। এটি তার অপরাধ। তবু শেষ অবধি করুণা বশেই তাকে থানায় টানলো না। অবশ্য এদিকে দুপুর হোল, অন্য সকলের মত প্রহরীও মধ্যাহ্নভোজের জন্য বাড়ি যেতে ব্যস্ত হয়েছে। তাই লেখককে আবর্জনা ও সরকারের সম্পর্কের বিষয়ে গভীর চিন্তার অবসর দিয়ে চলে গেল। নানা অসঙ্গতি ও অন্যায় যে দেশের কলঙ্ক, সেখানে স্বতপ্রণোদিত হয়ে কিছুর সংস্কার করতে গেলে, তারই বিপদ!

(দেশ : ১২ ফাল্গুন ১৩৭৩)







কৃতজ্ঞতা:
বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ
কলকাতা- ৭

Comments

Popular posts from this blog

টাইম ম্যানেজমেন্ট

চিন্তার বিষয়

সব আমি করেচি! আমি!