সব আমি করেচি! আমি!

কলকাতায় থাকেন অথচ কলকাতাকে গর্বের সাথে ভালোবাসেন না, এইরকম মানুষের সংখ্যা খুবই কম। যদি খুব মন দিয়ে মেশা যায়, তবে এই যে ভালোবাসি বলা বিরাট অঙ্কের মানুষ, তাদের দুভাগে ভাগ করা যায়। একদলের জীবনে কলকাতা শব্দটা অতীব কাব্যিক এবং কাল্চার্ড। তাঁরা কলকাতার রস না বুঝলেও, কলকাতাকে ভালো বললে যে সহজেই জাতে ওঠা যায়, সেটা বুঝতে পেরেছেন। তাদের ভালবাসার মূলমন্ত্র হল, ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি। টুকিটাকি ঝালমুড়িতে ভিক্টোরিয়া দিয়ে তাদের কলকাতার শুরু, ফ্রেমিং লাইটিং না বুঝলেও দামী ক্যামেরা বগলে পুজোর আগে কুমোরটুলি দিয়ে টুকটাক লোকদেখানো আর হলুদ ট্যাক্সি নিয়ে ফোটোশ্যুট দিয়েই তাদের কলকাতার শেষ। আর বাকি খুব ছোট দলটা, এসব কাটিয়ে বেশ আয়েস করে হাঁটুজল, চাঁদা, ভীড়মিনিবাস, আইলিগ, সিপিয়েমতীনোমূল, বাঙালঘটি, তুমুল চ্যাঁচামেচি, ফুটপাতে দরদাম এই সমস্ত কিছুর সাথেই নিজেদের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তাঁরা উঠতে বসতে, প্রতি মুহূর্তে কলকাতাকে গালমন্দ করেন। তাদের প্রেমটা, একান্নতম বিবাহবার্ষিকীর রাতে, কে নাক ডেকেছিল, সেই নিয়ে বেডরুমে ঝগড়া করে উল্টোপাশ ফিরে শুয়ে পড়ার মতো। যাই হোক, আপাতত এইসব রিক্সা-ফিক্সা বাদে, যে জিনিসগুলো ফাইন লাইনে দাঁড়িয়ে, নাক ডাকার মতো এফিশিয়েন্টলি টিকি জ্বালিয়ে দিয়ে মুচকি হাসে, সেগুলোর একখানাই আলোচনার বিষয়।
আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রায় আশি বছরের বেশি সময় ধরে লক্ষ্মী-সরস্বতীর পুজো হয়ে আসছে। সেই উপলক্ষ্যে যে যেখানেই থাকুক, মোটামুটি কাজ বাঁচিয়ে পুজো অ্যটেন্ড করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমার আবার পরীক্ষার হাতছানি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছেনা এ জীবনে। অতয়েব একলাই রয়ে গেলাম। বাড়ি খালি। এই খালি বাড়ি শব্দটা, যেকোনো যুবক যুবতীর কাছেই কেমন যেন গা শিরশির করানোর মত। এই খালি বাড়িকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কত কী উপায়ে ব্যবহার করা যেত, সেটা ভাবলেই এখন কান্না পায়। আমার পৌরুষের দিকে তাকিয়ে আমার দেওয়ালগুলোও মুচকি হাসে। কিন্তু রূঢ় বাস্তব, আমার কেউ নেই।

আমার পড়বার ঘরটা একতলায়। আর সেই ঘরের জানলার বাইরেই গোটা শিয়ালদাটা ঠিক যেন ছুটে এসে ধাপ্পা দেবে বলে ওঁত পেতে বসে থাকে। শিয়ালদা একটা খুবই আশ্চর্যজনক জায়গা। যা কোত্থাও দেখা যায় না, এমনকি কল্পনাও করতে পারেনি কেউ কোনোদিন, সেগুলোও শিয়ালদায় খুবই সাধারণ ঘটনা। এখানে কেউ হেঁটে যায় না; সবাই ছুটে যায়। আমাদের বাড়ির গলিটা আমহার্স্ট স্ট্রিট আর হ্যারিসন রোডের কানেক্টার। জ্যামের চাপে গলিটা বাইপাস রোড হয়ে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে এই গলি দিয়ে মিনিবাস ঢুকলেও পাড়ার কেউই অবাক হবে না। এ বছর তিথি অনুযায়ী সরস্বতী পুজো পড়েছিল শনিবার-রোব্বার দুদিনই। সেই সুযোগে, লুকিয়ে বিড়ি টানার পয়সা জোটাতে কচি কচি বামুনগুলোও টেস্টপেপার ফেলে বেরিয়ে পড়েছিল সাইকেল নিয়ে। এক একজনের আট-দশটা করে পুজোর অর্ডার। উচ্চমাধ্যমিক পাস করা বামুনগুলো চেনা পরিচিতের পাড়ায় পুজো করতে গেলে, দক্ষিণা আর আলো চাল তো দূরে থাক, বেমালুম খিস্তি খেয়ে বাড়ি ফেরাই এই তল্লাটের চল। কোনো কোনো অতি পাকা ছেলে চরম উত্তেজনা নিয়ে বামুন হয় আর পুস্পাঞ্জলীর জন্যে বড়বড় গ্যাঁদাফুল ভালো দেখতে মেয়েদের দিকে আর ছেলেদের দিকে পোকায় কাটা বেলপাতা এগিয়ে দেয়। কিন্তু এভাবে পরাগমিলন যে সম্ভব নয়, তা ওদের বোঝার বয়স হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই পুজোর পরে এরাই এন্তার খিস্তি  আর মারধর খেয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

আমার পড়ার ঘরের বাইরেই একটা ক্লাবের সরস্বতী পুজো হয়। ওদের ক্লাবের নাম ঠিক কী, সেটা কেউই জানে না। এমনকি নাম ঠিক নিয়ে মাঝেমধ্যেই ওদের নিজেদের মধ্যে মারপিট লেগে যায়। একবার ওরা বিশ্বকর্মা পুজোও করেছিল। কিন্তু কেন করেছিল, তা আমাদের কাছে ভীষণ রহস্যের সৃষ্টি করেছিল।  শুক্রবার বিকেল থেকেই প্যান্ডেল থিম এসব নিয়ে, মোড়ের মাথায় তুমুল আলোচনা আর হইচই শুরু হয়ে যায়। মাঘের শেষ আবহাওয়া ভালো ছিল না বলে জানলা বন্ধ রাখতে হত। মাঝ রাতে হঠাৎ শুনতে পেলাম, কমিটির আলোচনাটা ক্রমশ চ্যাঁচামেচি ছাড়িয়ে হাতাহাতিতে পৌঁছেছে। শিয়ালদা অঞ্চলে যারা বহুকাল আছেন, মারপিটের কোলাহল তাদের কাছে প্রেশার কুকারের  সিটির মতই স্বাভাবিক। আমার হঠাৎ মনে হল আবার জানলা ঘিরে প্যান্ডেল হলে আমার ড্যাম্প ঘরটা আমায়  আরও মুস্কিলে ফেলবে। তারপর ভোরের দিকে চ্যাঁচামেচিটা সম্পূর্ণ থেমে গেল। সিগারেট ধরাতে জানলা খুলে দেখি, হস্টেলের সাইজের শুধু একটা তক্তপোশ রাখা হয়েছে। একটা নেড়ি কুকুর তার ওপর গোল হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। তারপর ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন মনে নেই। বেশ খানিকটা বেলার দিকে ধূপধুনোর গন্ধে ঘুম থেকে উঠে দেখি, ওরা ভর দুপুরেই পুজো করে ফেলেছে!আমাদের কমিটির তর-টর বিশেষ সয়না। মোদ্দা কথাটা হল, নাউ অর নেভার।

সরস্বতী পুজোয় সব মেয়েকেই বড্ড বেশি ভালো দেখায়। সেটা সত্যিই ভালো দেখায় নাকি আমার খরা যৌবনের ফল, তা নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো। যাই হোক, বেলা হলেও চান-ফানের ঝক্কি পোহাতে আর ইচ্ছে হল না। যে সাদা পাজামাটা পরেছিলাম, তার ওপরে একটা জামা গলিয়ে ভাতের হোটেলের সন্ধানে বেরোতে হল। এই পাজামাটা সম্ভবত ছিল দাদুর। দাদুর ধুতি পরা অভ্যেস ছিল বলে, পাজামাটা বাবা নিয়েছিল কিন্তু আজকাল এসব ঢলঢলে পাজামার চল নেই বলে মালটা আলমারির কোণে ন্যাপথালিন শুঁকে নেশা করে পড়েছিল। আমার পরার কিছু নেই বলে আমি নিয়েছি। আর জামাটা ক'বছর আগেও নেভি ব্লু ছিল, এখন আকাশী। এদিকে রাস্তায় চারিদিকে শুধু হলুদ শাড়ি আর শ্যাম্পু চুলের ঝটকায় দিশেহারা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ভাতের হোটেলের মাছের ঝোলটা প্রায় সিপিএমের পতাকার মত লাল। তাই অখাদ্য নিরামিষ একটা তরকারি দিয়ে খানিকটা ভাত খেতে বাধ্য হলুম। ফেরার সময় একখানা সিগারেট ধরাতেই হল, কারণ এছাড়া আর স্টাইল মারার মত কিছু ছিল না। যদিও আমার এক বিশেষ বান্ধবী বলেছিল, স্টাইল মারলে নাকি আমাকে আরও খারাপ দেখায়। বাড়ি ঢোকার সময় দেখা গেল, ওই ছোট্ট তক্তপোশে পাড়ার কোনো বৌদির একটা কলমকারী শাড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে কায়দা করা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে পুজো-হলেই-দিয়ে-যাবো ধরনের কিছু গুল দিয়ে বৌদিকে পটানো হয়েছে। প্যান্ডেল বলতে ওই তক্তপোশের ওপর লাল কাগজে মোড়া একটা ইঁটে দেড়ফুটের একটা ঠাকুর রাখা আছে। পাশে বাতাবিলেবু গ্যাঁদাফুল কুলটুল সব ছড়িয়ে বেশ শীতকাল শীতকাল গন্ধ। সামনে কাঠের রেকাবিতে গোটা কয়েক দশটাকার নোট। এদের পাড়ার কেউ টাকা দেয় না। দিলেই হাড়কাটার গাঁজা কিনে খায়। যাইহোক, আর তক্তপোশের পাশেই দেখা গেল, বেশ বড়বড় বক্স নিয়ে গানের ব্যবস্থা হচ্ছে।

আপাতত দুদিন পড়াশোনা লাটে উঠবে। এর চেয়ে গ্রামে চলে গেলে পড়ন্ত সন্ধ্যের আলোয় জমির আলে বসে ফুলুরি আর সিগারেট খাওয়া যেত.. এসব ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে দুলাইন পড়তে না পড়তেই, পিলে চমকে বিরাট বক্সে জোমাটোর অ্যাড শুরু হল! মাথায় মাফলার জড়িয়ে আবার পড়ার ফালতু চেষ্টা করতে করতেই কিশোর কুমারের গাওয়া সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ গান "ধোঁয়া ধোঁয়া" গানটা  শুরু হল। বিরক্ত হয়ে পাশের ঘরে চলে যেতে হল। ধোঁয়া ধোঁয়া গানটা শেষ হতে না হতেই আবার পুজো কমিটির সভাপতির সঙ্গে কোষাধ্যক্ষের মারপিট শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আমার এক পরম বন্ধু শিখিয়েছিল, কীভাবে প্রক্সি ওয়েবসাইট দিয়ে ব্যান হওয়া ওয়েবসাইট গুলো সন্তর্পণে খোলা যায়। অগত্যা লেপের তলায় আশ্রয় নিতেই হল। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।

ঘুম ভাঙতেই সব শুনশান দেখে জোর ভয় পেয়ে ধরমড়িয়ে উঠে জানলা দিয়ে দেখি সব শুনশান। একটু পরে আলোচনা শুনে মনে হল কেউ কারেন্টের তারে পা দিয়ে শক্ খেয়ে পাড়ায় হুলুস্থুল কান্ড করেছে। তাকে নাকি মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলে ঘন্টা খানেক পর ছেড়ে দেওয়া হয়। মেডিকেলে ওষুধ নাকি ভুল দেওয়া হয়েছে এবং কী ওষুধ দেওয়া উচিত ছিল সেই নিয়ে সন্ধ্যেবেলা জোর সিরিয়াস একখানা তর্কসভা বসল। তর্কসভায় শক্ খাওয়া সেই মক্কেল নিজেও মধ্যমণি হয়ে বসে রইল। তারপর কোন ডাক্তারটা ডবকা, কেন ডবকা আর কোন ডাক্তারটা হারামি সেসব চরম উৎসাহে আলোচনা চলতে লাগল। তারপর কবে ভোগ হবে, সেই নিয়ে আবার তক্কো শুরু হল। সাদা পাঞ্জাবী পরে, বিখ্যাত কাজের-মানুষ-কাছের-মানুষ আসতেই হইচইটা থেমে গেল। তারপর সেই কাছের-মানুষ ভুলভাল বাংলায় কিছু বাণী দিয়ে, লোকসভা ভোটের মিছিল লম্বা করার জন্যে পাবলিক অর্ডার দিতে, এই রেকাবিতে দু হাজার টাকার নোট রেখে দিলেন। দাদার নামে জয়ধ্বনি পড়ে গেল। আমি ইতিমধ্যে দু একবার পড়বার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি। এবার রাতে কী খাবো তাই ভাবতে ভাবতেই আবার বক্স বাজা শুরু হল। বাইরের রান্না খাওয়ার চেয়ে নিজে রান্না করাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হল। খানিকটা ভাত ফুটিয়ে ফ্রিজ থেকে দুচামচ ঘি দিয়ে চুপচাপ খেয়ে, আওয়াজের চোটে বিরক্ত হয়ে দোতলাতেই সিগারেট ধরিয়ে বসে রইলাম। রাত এগারোটা নাগাদ, কমিটির তরফে একটা থার্মোকলের থালায় গরম খিচুড়ি আর পাকা পালংশাকের অতীব জঘন্য রেসিপির ঘন্ট দিয়ে গেল। প্লেটটা কায়দা করতে গিয়ে খানিকটা খিচুড়ি এনসিইআরটির কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতায় ঢালা হয়ে গেল! তিতিবিরক্ত হয়ে হাতে ছ্যাঁকা খেয়ে বই পরিষ্কার করতে গিয়ে পাতাটাই ছিঁড়ে গেল। ঘি-ভাতে পেট অলরেডি ঠাসা, তবুও কড়কড়ে একশো টাকা চাঁদার বিনিময়ে খিচুড়ি; ছাড়া যায়! বাপের নাম ভুলিয়ে দেওয়ার মত শক্ত ডাঁটা চিবোতে চিবোতে গ্যাটারমান, পালং শাক, ব্ল্যাক হোল, জিনোম, মার্কনিকফ, স্যান্ডমেয়ার সমস্ত তালগোল পাকিয়ে একাকার হয়ে গেল। তারপর আলোটালো জ্বেলেই বইয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গভীর ঘুম দিয়ে দিলাম।

সরস্বতীর কৃপায় আমার ডাইজেস্টিভ সিস্টেম বাইজি নাচেনি। ঘি ভাত আলুসেদ্ধ খিচুড়ি পালংশাকের ঘন্ট সব যথাযথ ব্যবস্থায় চালান হয়ে গেছে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বেশ ফ্রেশ লাগল। সেদিনই আমাদের বাড়িতে পুজো। সত্যি বলতে কী,  যত কাজই থাকুক, দুগ্গাপুজোটা কলকাতায় আর সরস্বতী পুজোটা গ্রামের বাড়িতে থাকতে না পেলে মনটা বেশ খালি খালি লাগে। বেশিরভাগ জায়গায় সেদিনই যে পুজো হবে, সেটা সকালে চা খেতে বেরিয়ে বোধগম্য হল। আমার কাছে নিরামিষ খাওয়া আর পেটে কিল মেরে শুয়ে থাকা একই জিনিস। খুব ইচ্ছে হল আগডুম বাগডুম যা হোক রাঁধি। অগত্যা আড়াইশো মুরগীর মাংস কিনে ফেললাম। ফেরার পথে, কমিটির এক দাদার সাথে দেখা হতেই সে আমায় কব্জা করে বলল  "সত্যি করে বলতো ভাই কাল ক্যামোন হয়েছিল রান্নাটা! সব আমি ব্যবস্থা করেছি।"
পাশ থেকে আরেকজন ফস্ করে বলল, "হারামি! সকাল সকাল ঢপ দিচ্ছিস্! ভাই বিশ্বাস কর, বালটা মাল খেয়ে পড়েছিল! সব আমি করেচি! আমি!"
আমি ভাবলুম এই বুঝি সরস্বতী ঠাকুর তক্তপোশ ছেড়ে উঠে এসে বলবে  "ভাই বিশ্বাস কর, ওই বালদুটোই মাল খেয়ে পড়েছিল। সব আমি করেচি! আমি!"

ছবি সূত্র: Calcutta Instagrammers


Comments

Popular posts from this blog

চিন্তার বিষয়

My letter to The Chief Minister of West Bengal

উত্তম মাধ্যম