সপ্তাহের শেষ কবে? শনিবার নাকি রোব্বার? অনেকে অনেকরকম ভাবেন। তাতে তফাৎ কিছুই হয় না। সেরকমই একটা বছর শেষের চেয়ে বলা ভালো, একটা ক্যালেন্ডারের সব পাতাগুলো শেষ। তারিখ শেষ। আর আলাদা বলতে বিশেষ কিছু নেই। আবার মঙ্গলের পর বুধবার। তারপর বেস্পতি, শুক্কুর.. চলতেই থাকবে।
এই 'বছর শেষের' খানিক আগে যদি ভাবতে বসা যায় আমার হয়নি'র লিস্ট, তাহলে হালখাতার মত মোটা সুতোয় বাঁধা খাতা চাই। আর চাই কালি ফুরোবেই না, এরকম পেন। আমি তো রবীন্দ্রনাথ বা বিভূতিভূষণ নই, আমি অনেক কিছুই ভাবি কিন্তু লিখে বা বলে প্রকাশ করা হয়ে ওঠে না; মাথাতেই গিজগিজ করে আর তারপর অজান্তেই মুছে যায়। কেবলই মুছে ফেলা গেলে বরং ভালো হত, কিন্তু হাত ধোয়ার পরেও লেগে থাকা হলুদটুকুর মত রয়ে যায়। চলার পথে লোকজন যা যা পায়, তার দশগুণ হারিয়ে ফেলে। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

সালটা দু হাজার চোদ্দ। প্রথম ব্লগ। আইডিয়েট ক্রিয়েশান। উদ্দেশ্য ছবি আর লেখা। দিদি একখানা ক্যামেরা দিয়েছিল। সনি সাইবারশট। সেটা নিয়ে কলকাতার এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে ক্যামেরা করতে ভালো লাগত। একলাই ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ার আগেই এল পনেরো। দু হাজার পনেরো সাল। ফেসবুক তখনও বাংলা কী প্যাডের কচকচানিতে অভ্যস্ত হয়নি। প্রচুর ব্যর্থতার ফ্রাস্টু নিয়ে লেখালেখি শুরু। যাদের বিগত শতাব্দীতেও টিকি পাইনি, সেসব সহৃদয় গার্জেনরা আমার বাপের কাছে নালিশ করে বসল, বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে সাহিত্যানুরাগ তো কোন কাজের কথাই নয়! ব্যাপারটায় এবং ব্যাপারটার প্রজেক্ট করার ধরনে বাপ যে বিশেষ খুশি হয়েছিল, এমন বলা যায় না। যাই হোক, আস্তে আস্তে জুটতে লাগলো বিভিন্ন নেগেটিভ সমালোচনা আর পাল্লা দিয়ে লম্বা হল ফ্রেন্ডলিস্ট। সিনেমার মত কাঁচা প্রেমের টুকটাক মিষ্টি কথোপকথন, যেগুলো বলার ইচ্ছে হত কাউকে, কিন্তু কেউ ছিল না বলে মন উসখুস করত। সেই অভাব পূরণেই আমদানি করে ফেললাম নতুন হ্যাসট্যাগ মিথ্যে খেলার সত্যি আনন্দ।

তারপর সেপ্টেম্বরের এক দুপুরে একজন কী একটা ঘরোয়া ছোটছবি করবে বলে মেসেজ করল। দেখা হল। গল্পটা মিষ্টি। একটা ক্লাসে বেশ ডাকসাইটে এক মেয়ে আর দুজন সহপাঠীর প্রেমের গপ্প। চিঠি লেখা নাকি লিখে দেওয়া; সেই নিয়ে গপ্পো। গপ্পের খপ্পরে আমরা পড়েছিলাম। তারপর কেন যেন সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আমরা দুঃখ করিনি বিশেষ। সিগারেটের ধোঁয়ায় পুড়িয়ে দিয়েছি।

এক বন্ধু পড়ত ইঞ্জিনিয়ারিং। কলকাতা ছাড়ার ইচ্ছে তার একটুও ছিল না; ছাড়তে হয়নি যদিও। ছোকরা তার সেই ভীতি নিয়ে একখানা প্লট বেঁধেছিল। আমিও উঠে পড়ে লেগে গেলাম। আমাদের পুঁজি কম ছিল। মোবাইলের ক্যামেরায় কলকাতার রাস্তায় শ্যুট করেছি দুজনে। জঘন্য হয়েছে। আবার করেছি। বহুবছর ধরে ঘরে, ছাদে, রাস্তায় যাচ্ছেতাই রকমের চেষ্টা করেও প্রজেক্টটা দাঁড়ায়নি।

তারপর দু হাজার ষোল। নিজের ছ্যাঁকা খাওয়া আর সেটা কী হলে কী হতো সেসব মিশিয়ে 'টাইম ম্যানেজমেন্ট' আর তার এফেক্টে পিটুইটারী, অ্যাড্রিনালিন আর ডোপামিনের চচ্চড়ি হয়ে গিয়েছিল। তারপর জুলাই নাগাদ লিখে ফেললাম বিসর্জন। উঁহু। তখনও কৌশিক গাঙ্গুলীর বিসর্জন আসতে অনেক দেরী। গপ্পটা আমার। ওইসব বন্ধুরাই সাগরেদ। কেউ ক্যামেরা কেউ এটা কেউ ওটা। ওদের ভরসাতেই খুঁজে পেলাম আমার ছবির নায়িকা। গপ্পের শেষটা প্রেডিক্টেবেল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কাস্ট ক্রিউ ঠিক হল। নাওয়া খাওয়া ভুলে লোকেশন ম্যাপ করেছি খুব। বিশ্বভারতীর এক ছাত্রীর সাথে বালিগঞ্জ সাইন্স কলেজের এক ছাত্রের গপ্পো। দুজনের আলাপ ফেসবুকে। কিন্তু তারপর তাদের আর দেখা হয়নি কখনও। আর সিনেমাটাও করা হয়নি কখনও।
তারপর সতেরো সালের ফেব্রুয়ারি। আর একখানা গপ্পো ধরে ফেললাম। ইস্কুলে পড়তে অনেক সময় প্যারেন্টিঙের দোষে অকারণে দুজনের মধ্যে রেষারেষি তৈরী হয়ে যায়। তারপর ইস্কুল ছাড়ার বহু বছর পর আন্তরিক রেষারেষি থেকে মুক্তি। গপ্পের গোড়ায় নাম দিলাম দ্যা লাস্ট সিগারেট। তারপর সেটা বদলে করে দিলাম, দ্যা ম্যাচবক্স। এক বন্ধু সেটা নিয়ে বেদম খাটাখাটনির পরেও দাঁড়ায়নি। সতেরোর পুজোর সময় ঠিক ওই গপ্পের একখানা ছোটছবি ইউটিউবে নজরে পড়েছিল। খারাপ লেগেছিল তা না, তবে দুর্দান্ত কিছু লাগার কথাও নয়।

সতেরোর অগস্টে লিখে ফেললাম আর একখানা গপ্পো। গপ্পের মূল ভাবনাটা ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা সুলভ সমাচার। চাঁদনির নন-এসি মদের দোকানটা যেমন চাকরি পাওয়ার পরে বদলে যায় পার্কস্ট্রীট। তবুও অগস্টের দুপুর রোদ্দুরে চাঁদনির খোঁজে আমাদের বেশী হন্যে হতে হয়নি। তারপর সেই অক্টোবরে লিখে ফেললাম, ভিক্টোরিয়া। ছোটদের মন নিয়ে বড় মনের গপ্পো। গপ্পোটা আমাদের পছন্দ ছিল খুব। খেটেছি বিস্তর। লন্ডনের এক এনজিও রাজি হয়েছিল সাথে থাকবে বলে। আমরাই বিলিতিদের থেকে হাত পাততে চাইনি।

লোকে কী বলবে, যদি খারাপ বলে, যদি হাসাহাসি করে! সেই ভীতি কাটিয়ে ওঠা হয়নি। তারপর যতটুকু উদ্যোগ বাকী থাকত, সেটাও হারিয়ে গেছে গাফিলতির স্রোতে। শেষমেশ কলকাতার বহু টুকিটাকি গল্প নিয়ে একটা ব্লগ খুলে ফেললাম। ক্যালকাটা ক্যাফে। সেটাও যা হোক করে হারিয়ে গেছে। প্রতিটা প্রজেক্ট বাতিল হয়ে গেছে নির্দ্বিধায়। সময়ের কোলে হারিয়ে গিয়েও রয়ে গেছে মনের কোণে কোণে।

চুপচাপ বসে কখনও কখনও নিজেকে বলতে ইচ্ছে হয়, অ্যান্ড ইউ উইল বি, আ, সেন্ট পার্সেন্ট বাঙালী, মধ্যবিত্ত, ছাপোষা, কনভেনশানাল, গুড বয়!



Comments

Popular posts from this blog

চিন্তার বিষয়

My letter to The Chief Minister of West Bengal

উত্তম মাধ্যম